বৃহস্পতিবার- ২৭ মার্চ, ২০২৫

হাছান মাহমুদের দোসরদের বাধায় রাঙ্গুনিয়ায় ফেরা হলোনা সেই বৌদ্ধ ভিক্ষুর!

হাছান মাহমুদের দোসরদের বাধায় রাঙ্গুনিয়ায় ফেরা হলোনা সেই বৌদ্ধ ভিক্ষুর!
print news

ট্টগ্রাম-৬ রাঙ্গুনিয়া আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও তার ভাই খালেদ মাহমুদ-এরশাদ মাহমুদের রোষানলে পড়ে হামলা-মামলার শিকার হয়ে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার পদুয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ফলাহারিয়া জ্ঞান শরণ মহারণ্য বৌদ্ধ বিহার ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল বৌদ্ধ ভিক্ষু ধুতান্ত সাধক ভদন্ত শরনাংকর মহাথেরোকে।

গত বছর ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্প্রতি সেই বৌদ্ধ বিহারে ফিরতে চেয়েছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু ধুতান্ত সাধক ভদন্ত শরনাংকর মহাথেরো। কিন্তু বিধিবাম, হাছান মাহমুদ ও তার ভাইয়েরা এখন এলাকাছাড়া হলেও তাদের দোসরদের তোপের মুখে আর ফেরা হলো না বৌদ্ধ ভিক্ষু ধুতান্ত সাধক ভদন্ত শরনাংকর মহাথেরোকে।

এ নিয়ে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে কোন বক্তব্য পাওয়া না গেলেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বক্তব্য মিলেছে। এ বিষয়ে রাঙ্গুনিয়া মডেল থানার ওসি সাব্বির মোহাম্মদ সেলিম বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) রাতে বলেছে, আগামী ১০ জানুয়ারি শুক্রবার পদুয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ফলাহারিয়া জ্ঞান শরণ মহারণ্য বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ ভিক্ষু ধুতান্ত সাধক ভদন্ত শরনাংকর মহাথেরোর আসার কথা ছিল। তার অনুসারিদের সাথে স্থানীয় মুসলিম, হিন্দু ও বনবিভাগের লোকজনের দ্বন্দ্ব রয়েছে।

তার আগমন ঠেকাতে ইসলামী দলগুলো সম্মিলিতভাবে স্মারকলিপি ও বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা করে। গত ৮ জানুয়ারি হেফাজতে ইসলাম রাঙ্গুনিয়া উপজেলা শাখার পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, রাঙ্গুনিয়া ও দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া মডেল থানার ওসি, খুরুশিয়া রেঞ্জ বীট কর্মকর্তাকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এই পরিস্থিতিতে এলাকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্টের কথা চিন্তা করে বৌদ্ধ ভিক্ষুর পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার উপজেলা প্রশাসনকে মৌখিকভাবে রাঙ্গুনিয়া আসার কর্মসূচি বাতিলের কথা জানানো হয়েছে।

কিন্তু স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বলছেন অন্য কথা। তাদের ভাষ্য, বৌদ্ধ ভিক্ষুর আসার খবরে স্থানীয় মুসলিমদের কোন রকম বাধা, প্রতিবাদ বা কোন কর্মসূচি কারো নজরে পড়েনি। বরং প্রশাসন থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, বৌদ্ধ ভিক্ষুর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। বৌদ্ধ বিহারে আসলে তিনি গ্রেফতার হবেন। এতে এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হতে পারে। ফলে বৌদ্ধ ভিক্ষু ধুতান্ত সাধক ভদন্ত শরনাংকর মহাথেরো যেন না আসেন।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের অভিযোগ, বৌদ্ধ বিহারের জমি জবর দখল নিয়ে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে চট্টগ্রাম-৬ রাঙ্গুনিয়া আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও তার ভাই খালেদ মাহমুদ-এরশাদ মাহমুদের রোষানলে পড়ে হামলা-মামলার শিকার হন রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার পদুয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ফলাহারিয়া জ্ঞান শরণ মহারণ্য বৌদ্ধ বিহারের বৌদ্ধ ভিক্ষু ধুতান্ত সাধক ভদন্ত শরনাংকর মহাথেরো। কারণ ওই জমি দখল করতে চেয়েছিলেন ড. হাছান মাহমুদ ও তার ভাই খালেদ মাহমুদ-এরশাদ মাহমুদ।

এই সময়ে নানা প্রলোভন দেখিয়ে হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে তাদের অনুসারিদের দিয়ে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি ও হামলা-মামলা করায় বৌদ্ধ বিহার ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। গত বছর ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্প্রতি সেই বৌদ্ধ বিহারে ফিরতে চেয়েছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু ধুতান্ত সাধক ভদন্ত শরনাংকর মহাথেরো।

কিন্তু তার আগমনের খবরে হাছান মাহমুদের অনুসারি দোসররা স্থানীয় ও বিভিন্ন ইসলামিক সংগঠনের নামে তার আগমন ঠেকাতে উপজেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপিও দেওয়ার কথা জানায়। এমনকি রাঙ্গুনিয়ায় ফিরলে এই বৌদ্ধ ভিক্ষুর বিরুদ্ধে থানায় দায়ের করা একাধিক মামলায় গ্রেফতারের ভয় দেখানো হচ্ছে। ফলে তিনি রাঙ্গুনিয়ায় না এসে কিছুদিন রাউজানে অবস্থান করে বিদেশ যাওয়ার পূর্বে কক্সবাজারের রামুতে যাবেন বলে জানানো হয়েছে।

হাছান মাহমুদ অনুসারিদের অভিযোগ, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে স্থানীয় ফলাহারিয়া পাঠান আউলিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার সদকাকৃত গরু বিহারের এলাকায় ঢুকে ঘাস খাওয়ার দায়ে ভদন্ত শরনাংকর মহাথেরোর অনুসারিরা মাদ্রাসায় হামলা ও ভাঙচুর করে। এছাড়াও আজান ও নামাজের সময় বৌদ্ধ ভিক্ষু মাইক বাজিয়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতো।

এছাড়া পদুয়া ইউনিয়নের ফলাহারিয়া এলাকায় শাহ্ সুফী হযরত পাঠান আউলিয়ার ২০০-২৫০ বছরের পুরনো একটি মাজার রয়েছে। ওই মাজারকে কেন্দ্র করে ২০১৪ সালে মাওলানা মোহাম্মদ হাকিম উদ্দিন আল কাদেরী একটি সুন্নীয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। মাজার থেকে জ্ঞান শরণ মহারণ্য বৌদ্ধ বিহারের দূরত্ব আনুমানিক দুই কিলোমিটার। ফলাহারিয়া গ্রামের প্রধান সড়ক থেকে একই পথে মাজার অতিক্রম করে বৌদ্ধ বিহারে যেতে হয়। বৌদ্ধ বিহার কর্তৃপক্ষ প্রধান সড়ক থেকে মাজার ও বিহারের দিকে প্রবেশ পথে বৌদ্ধ মূর্তি সম্বলিত গেট নির্মাণের চেষ্টা করলে মাজার কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় মুসলমানদের সাথে বৌদ্ধ বিহার কর্তৃপক্ষের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে স্থানীয় কিছু মুসলিমদের পানি পড়া দিয়ে মুশরিক বানানোর অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর বৌদ্ধ ভিক্ষু শরনাংকর মহাথেরোর নেতৃত্বে বনবিভাগের জায়গা দখল চেষ্টার অভিযোগ ওঠে। একই সময়ে ভিক্ষুর অনুসারী প্রায় অর্ধশত লোক বনবিভাগের কর্মীদের ওপর হামলা করে। এ ঘটনায় একই বছরের ৩০ অক্টোবর বৌদ্ধ ভিক্ষু শরনাংকর মহাথেরোর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৩৫ থেকে ৪০ জনের বিরুদ্ধে রাঙ্গুনিয়া মডেল থানায় মামলা দায়ের করে বনবিভাগ কর্তৃপক্ষ। এই মামলায় হাছান মাহমুদের প্রভাব ছিল বলে অভিযোগ উঠে।

পরবর্তীতে ২০২০ সালের ৭ জুন খুরুশিয়া রেঞ্জের বনবিভাগের নার্সারির আনুমানিক ৭৫ হাজার চারাগাছ কেটে ফেলা হয়। ওই ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৭ থেকে ৮ জনকে আসামি করে ৯ জুন রাঙ্গুনিয়া মডেল থানায় মামলা দায়ের করে বনবিভাগ। কিন্তু এই গাছ কাটা নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও হাছান মাহমুদের প্রভাবে প্রশাসন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের কারো কথা শুনেননি।

এছাড়া বৌদ্ধ ভিক্ষু শরনাংকর মহাথেরোরের অনুসারিদের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক স্থানীয় হিন্দুদের শ্মশানের জায়গা দখল করার অভিযোগ তুলে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে মারামারির ঘটনাও ঘটে। এ ঘটনায় ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাঙ্গুনিয়া মডেল থানায় একটি মামলা হয়। যা সাজানো ছিল বলেও জানান স্থানীয় বৌদ্ধরা।

কে এই শরনাংকর মহাথেরো :

ভদন্ত শরনাংকর মহাথেরোর চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার বড়ুয়া পাড়া মধ্যম মার্দাশা এলাকার দিলীপ বড়ুয়ার ছেলে। তিনি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শিলক ইউনিয়নের ফিরিঙ্গিরখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করেন এবং শিলক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে এসএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি রাউজান উপজেলার হাজী বাদশা মাবিয়া কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন।

জানা যায়, ভদন্ত শরনাংকর মহাথেরো ২০০৪ সালের ২৪ অক্টোবর সন্ন্যাসী জীবন গ্রহণ করেন। তিনি ২০১১ সালে ফলাহারিয়া এলাকায় বসবাসকারী বৌদ্ধ ধর্মাবল্বীদের সহায়তায় পাহাড়ের ওপর গর্তে ধ্যান শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে তিনি পদুয়া ইউনিয়নের সুখবিলাস এলাকার সেই পাহাড়ে প্রায় ২০১ একর জমির উপর ‘জ্ঞান শরণ মহারণ্য বৌদ্ধ বিহার’ প্রতিষ্ঠা করেন।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page