বুধবার- ৯ এপ্রিল, ২০২৫

সমীক্ষার সাথে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক

কর্ণফুলী টানেলে এক বছরে গচ্ছা ১০০ কোটি টাকা!

কর্ণফুলী টানেলে এক বছরে গচ্ছা ১০০ কোটি টাকা!
print news

চীনের সাংহাইয়ের আদলে চট্টগ্রামকে ওয়ান সিটি টু টাউন হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মাণ করা হয়েছিল টানেল। কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়কে মূল শহরের সাথে যুক্ত করাই ছিল টানেল নির্মাণের অন্যতম লক্ষ্য।

যা পূরণ হলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরণের অবদান রাখবে, বাড়বে জিডিপি-এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছিল টানেল নির্মাণের আগে পরিচালিত সমীক্ষায়। সে অনুযায়ী টানেল তৈরীর মধ্য দিয়ে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড় চট্টগ্রাম শহরের সাথে যুক্ত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু অর্থনীতিতে কোন অবদানই রাখতে পারছে না কর্ণফুলী টানেল। উল্টো টানেল চালুর এক বছরের মাথায় লোকসান দাড়িয়েছে ১০০ কোটি টাকারও বেশি।

এর মূল কারণ টানেল নির্মাণের সমীক্ষা অনুযায়ী গাড়ি চলাচল না করা। শুধু তাই নয়, সমীক্ষা অনুযায়ী কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে গড়ে উঠেনি কোন শিল্পাঞ্চল, আবাসন ও পর্যটন। ফলে বাড়েনি যানবাহন চলাচল। এতে প্রত্যাশা অনুযায়ী মিলছে না টোলের অর্থ। বরং বাড়ছে টানেল রক্ষণাবেক্ষন ব্যয়। তাতে ভারী হচ্ছে লোকসানের পাল্লা।

কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, নির্মাণের আগে বলা হয়েছিল টানেল দক্ষিণ চট্টগ্রামকে শুধু নয়, বাংলাদেশকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিল্পায়ন, আবাসন ও পর্যটনে এই টানেল প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে। কক্সবাজার-চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেওয়া ছাড়াও টানেলের মাধ্যমে প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এই টানেল দেশের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ০.১৬৬ শতাংশ বাড়াবে।

টানেল নিয়ে পরিচালিত সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, টানেল ব্যবহার করে প্রতিদিন ১৮ হাজার ৪৮৫টি গাড়ি চলাচল করবে। বছরে চলাচল করবে প্রায় ৭৬ লাখ গাড়ি। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর টানেল চালু হয়। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পরে এসে টানেলে গাড়ি চলাচলের সেই হিসাব মিলছে না।

২০২৪ সাল পার হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, টানেলে প্রতিদিন গাড়ি চলছে ৩ হাজার ৯১০টি। এই সংখ্যা সমীক্ষা বা প্রত্যাশার মাত্র এক চতুর্থাংশ। অপরদিকে যে গাড়িগুলো চলছে তার বেশিরভাগই ছোট গাড়ি। ফলে প্রত্যাশিত টোলের কাছেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

অন্যদিকে গত এক বছরের বেশি সময়ে আদায়কৃত টোলের চেয়ে একশ কোটিরও বেশি টাকা পরিচালন ব্যয় হিসেবে খরচ হয়েছে। এই খরচ ক্রমাগত বাড়ছে। মাস্টার রোল ভিত্তিতে লোকবল নিয়োগসহ টানেলের নানা খাতে বেশ কিছু অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এতে ব্যয় আরো বাড়ছে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।

সূত্র বলেছে, কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে উন্নয়নের যে লক্ষ্য নিয়ে টানেল নির্মাণ করা হয়েছিল তা হয়ে উঠেনি। ওপারে হয়নি আবাসন ও শিল্পায়নের মতো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম। ফলে টানেল দেখার আগ্রহ নিয়ে কিছু মানুষ যাতায়াত করলেও কক্সবাজার বা দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ টানেল ব্যবহার করছেন না। টানেলের অনেক আগে শাহ আমানত সেতু হয়ে পটিয়া বা আনোয়ারা যাতায়াত করা যায় মূল শহর থেকে। ফলে টানেলে গাড়ি চলাচল বাড়ার পরিবর্তে কমে আসছে।

বছরে ৭৬ লাখ গাড়ি চলাচলের প্রত্যাশা এবং সমীক্ষা রিপোর্ট থাকলেও বাস্তবে টানেল চালু হওয়ার পর থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত ১৫ লাখের মতো গাড়ি চলাচল করেছে। এসব গাড়ির মধ্যে প্রায় ৭৭ শতাংশ প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস। বাসের পরিমাণ ছিল ১০ শতাংশ, ট্রাকের পরিমাণ ১২ শতাংশ। অন্য কোনো গাড়ি টানেলে চলাচল করেনি বললেই চলে। ছোট গাড়ির টোল কম হওয়ায় টানেলের আয়ও কম হয়েছে। প্রতিদিন সাড়ে ১০ লাখ টাকার মতো টোল আদায় হয়েছে টানেলে। অথচ প্রতিদিন খরচ হয়েছে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা।

টানেলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে কৃত্রিম অক্সিজেন প্রবাহ এবং দিনের মতো আলো রাখা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, টোল আদায়সহ টানেল পরিচালন ও আলো সরবরাহ, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রতিদিন এই টাকা ব্যয় হয়।

সাম্প্রতিক হিসাবে বিগত এক বছরে টোল আদায় হয়েছে ৩৮ কোটি টাকার কিছুটা বেশি। অথচ পরিচালন ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৩৭ কোটি টাকা। বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা লোকসান দেওয়া টানেল কবে নাগাদ প্রত্যাশা পূরণ করবে তা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে।

এদিকে লোকসান কমাতে বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়া হচ্ছে টানেলের সার্ভিস এরিয়া। যার আওতায় আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৩০টি বাংলো এবং সাত তারকা মানের রেস্টহাউস, সম্মেলনকেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হেলিপ্যাড, মসজিদ, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন। আরও রয়েছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য নিয়ে একটি জাদুঘর।

Ctg Tunel 25.03 1

এসব স্থাপনায় শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা (এসি) বসানো হয়েছে ১ হাজার ১৮২ টন ক্ষমতার। প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে গত বছরের জুন মাসে। গত ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এটি হস্তান্তর করলেও ভবনগুলো অব্যবহৃত হিসেবে পড়ে রয়েছে।

টানেল সার্ভিস এরিয়া রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কর্ণফুলী টানেল ঘিরে গড়ে উঠা শিল্প কারখানা ও দেশী বিদেশী ব্যবসায়ীদের থাকার জন্য আবাসন প্রকল্প হিসেবে কর্ণফুলী টানেল সার্ভিস এরিয়া নামে ৪৫০ কোটি টাকার অত্যাধুনিক এই আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রকল্পের প্রতিটি বাংলাতে অত্যাধুনিক আসবাবপত্র ও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু এখানে কেউ আসেনা, মাঝে মধ্যে সেতু কর্তৃপক্ষের ঊর্ধতন কর্মকর্তা এবং কিছু রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, অতিথি এলেও প্রায় সময় ফাঁকাই থাকে পুরো রেস্ট হাউস এলাকা। অনেক সরকারী কর্মকর্তা সৌন্দর্য দেখতে আসেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বলেন, কর্ণফুলী টানেল সার্ভিস এরিয়া রিসোর্টটি আমরা বেসরকারি খাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দ্রুত দরপত্র আহ্বান করা হবে। এসব বাংলো পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত এমন কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হলে সরকারের লোকসান কমে আসবে। তবে টানেল থেকে আয় ও পরিচালন ব্যয়ের ফারাক দেখে আমরা অমানিশার ঘোর অন্ধকারে ঘুরছি।

প্রকল্পের তথ্যমতে, ২০১৩ সালে চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কো¤পানি (সিসিসিসি) পরিচালিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় কর্ণফুলী টানেল ২০১৭ সালে চালু হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। সেইসঙ্গে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, প্রথম বছরে টানেল দিয়ে দৈনিক গড়ে ১৭ হাজার ৩৭৪টি যানবাহন চলাচল করবে।

এ সংখ্যা ২০২০ সালে বেড়ে ২০ হাজার ৭১৯ এবং ২০২৫ সালে ২৮ হাজার ৩০৫-এ পৌঁছাবে। কিন্তু নানা জটিলতা পেরিয়ে এই টানেল উদ্বোধন হয় ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে। উদ্বোধনের সময় টানেলটি দিয়ে যানবাহন চলাচলের যে সম্ভাবনার কথা শোনানো হয়েছিল, তা এখন গালগল্পে পরিণত হয়েছে।

ফলে টোল আদায়ও অনেক কম। এখন মাসে টোল আদায় হচ্ছে গড়ে আড়াই কোটি টাকা। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ঠিকাদারের পেছনে মাসে খরচ প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা। এতে প্রতি মাসে গড়ে ঘাটতি প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা। এছাড়া কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৬০.৭৭ মিলিয়ন ডলার।

এছাড়া এই টানেল ঘিরে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলায় অর্থনেতিক জোন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। চায়না ইকনোমিক জোন গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাও এখন স্থিমিত হয়ে পড়েছে। সবমিলিয়ে এই টানেল এখন দেশ ও জাতির ঘাড়ে ভারী পাহাড় হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে।

উল্লেখ্য, চীনের ঋণ সুবিধায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় কর্ণফুলী টানেল। চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন্স নস্ট্রাকশন কো¤পানি (সিসিসিসি) টানেলটি নির্মাণ করে। ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলের সাথে মোট সড়ক নির্মিত হয়েছে ৯.৩৯ কিলোমিটার।

মূল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টিউব দুটি সমানমশরালভাবে নদীর তলদেশ থেকে ১৮ মিটার থেকে ৩১ মিটার গভীর (পানির লেভেল থেকে ৪১ মিটার) দিয়ে পতেঙ্গা ও আনোয়ারাকে যুক্ত করেছে। একটি টিউব থেকে অপর টিউবের দূরত্ব ১২ মিটার।

তবে টিউব দুটিতে যাতায়াতের চারটি পথ রয়েছে। ৩৫.৪ ফুট চওড়া ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলের একটি টিউবের দুই লেনে একমুখী গাড়ি চলাচল করে। অর্থাৎ একটি টিউব দিয়ে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারার দিকে গাড়ি যায়, অপরটি দিয়ে আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গায় আসে।

ঈশান/খম/বেবি

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page