
গাড়ির কাচ ভেঙে চাপাতি দিয়ে কোপানো এবং ‘গুলি কর, গুলি কর’ বলে চিৎকার—দৃশ্যটি কোনো সিনেমার নয়, বরং খোদ চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান খান এবং সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. বদরুল আরেফিন ভূঁইয়ার ওপর চালানো নগ্ন এক হামলা।
সেদিন ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে দশটা। ব্যস্ত চট্টগ্রাম মহানগরীর সিডিএ আবাসিক এলাকায় ঘটে গেল লোমহর্ষক এ ঘটনা। যা রাষ্ট্রের রাজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থার ওপর চরম এক আঘাত। যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে চোরাকারবারী সিন্ডিকেট কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
এই হামলাকারীদের লক্ষ্য যে কেবল ভয় দেখানো ছিল না, বরং তাদের প্রাণে মেরে ফেলার পরিকল্পনাও ছিল, যা কর্মকর্তাদের জবানবন্দিতেই অনুমেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই হামলার নেপথ্যে কারা? কেন তারা রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হলো?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও পুলিশের ধারণা, এই হামলার মূল কারণ অবৈধ পণ্য খালাসে বাধা দেওয়া। গত কয়েক মাসে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের এই দুই কর্মকর্তা এমন কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা অসাধু ব্যবসায়ীদের হাজার কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্যে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে। সম্প্রতি প্রায় ৪০ কোটি টাকা মূল্যের দুটি চালান জব্দ করা হয়েছে, যার মধ্যে ছিল আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য।
এর মধ্যে পাকিস্তান থেকে ‘পাখির খাদ্য’ ঘোষণা দিয়ে আনা হয়েছিল ২৫ টন পপি বীজ। পপি বীজ মাদক উৎপাদনের অন্যতম উপাদান, যা আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কৌশলী চোরাকারবারিরা কন্টেইনারের সামনে পাখির খাদ্যের বস্তা রেখে পেছনে পপি বীজ লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তাদের সতর্কতায় সেই চালান ধরা পড়ে যায়।
একইভাবে চীন থেকে ‘পলিঅ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড’ ঘোষণা দিয়ে আনা হয়েছিল ৩৯ টন ‘ঘনচিনি’ বা সোডিয়াম সাইক্লামেট। এই বিপুল পরিমাণ অবৈধ পণ্য আটকে দেওয়ার কারণে যে একটি বিশাল আর্থিক ক্ষতি সিন্ডিকেটের হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের সেই ক্ষোভ থেকেই এই হামলা।
কাস্টম কর্মকর্তাদের ভাষ্য, চোরাচালানের বিষয়টি কেবল রাজস্ব ফাঁকির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সরাসরি জনস্বাস্থ্যের জন্য এক বড় হুমকি। ধরা পড়া ওই ৩৯ টন ঘনচিনির কথা ভাবুন। এটি সাধারণ চিনির চেয়ে ৩০ থেকে ৫০ গুণ বেশি মিষ্টি। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী এই ক্ষতিকারক কৃত্রিম উপাদান ব্যবহার করে শিশুখাদ্য, বেকারি আইটেম, জুস, আইসক্রিম ও মিষ্টি তৈরি করে। এটি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় এবং স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
অন্যদিকে পপি বীজ মাদকের বিস্তার ঘটায়। আমাদের তরুণ সমাজকে ধ্বংস করার জন্য যে উপকরণ আমদানি করা হচ্ছিল, তা রুখে দিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা কি অপরাধ করেছেন? উল্টো তাদের ওপর চাপাতি নিয়ে হামলা চালানো হলো। এই ঘটনা প্রমাণ করে, চোরাকারবারীরা কেবল অর্থনীতির শত্রু নয়, তারা পুরো জাতির স্বাস্থ্যের শত্রু, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শত্রু। তারা তাদের মুনাফার জন্য পুরো জাতিকে বিষ খাওয়াতে বা নেশায় আসক্ত করতে দ্বিধা করে না।
এই হামলার ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। রাজস্ব কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান খান ও ডেপুটি কমিশনার মো. তারেক মাহমুদকে এর আগেও একাধিকবার ফোনে হুমকি দেওয়া হয়েছে। ৫ অক্টোবর এক ব্যক্তি ফোন করে কসমেটিকসের চালান ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এমনকি নিজেকে ‘সাজ্জাদ’ পরিচয় দিয়েও হুমকি দেওয়া হয়েছে। থানায় জিডি করার পরেও যখন প্রকাশ্য দিবালোকে হামলার ঘটনা ঘটে, তখন প্রশ্ন জাগে—এই সন্ত্রাসীদের খুঁটির জোর কোথায়?
কাস্টমস হাউস ঘিরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘ দিন ধরে সক্রিয়। তারা মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য এনে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়। যখনই কোনো সৎ কর্মকর্তা এই সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করেন, তখনই তাদের ওপর নেমে আসে খড়গ। এই সিন্ডিকেট কি এতটাই শক্তিশালী যে তারা আইনের তোয়াক্কা করে না? নাকি প্রশাসনের ভেতরেই ঘাপটি মেরে থাকা কেউ তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে? পুলিশের তদন্তে এই বিষয়গুলো উঠে আসা অত্যন্ত জরুরি।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা যখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করেন, তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যদি অবৈধ পণ্য আটকাতে গিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের রাস্তায় চাপাতির কোপ খেতে হয়, তবে ভবিষ্যতে কোনো কর্মকর্তা কি আর ঝুঁকি নেবেন? তারা কি তখন ভাববেন না যে, “চোখ বন্ধ করে সই করলেই যেখানে জীবন নিরাপদ, সেখানে কেন আমি আটকাতে যাব?”
যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, তবে তা হবে দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। সেখানে যদি কাস্টমস কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে এবং নিরাপদে কাজ করতে না পারেন, তবে চোরাচালান ও রাজস্ব ফাঁকির মহোৎসব শুরু হবে।
পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থাগুলোর কাছে প্রত্যাশা, সিসিটিভি ফুটেজ, জব্দ করা চালানের নথি এবং হুমকির কল রেকর্ড—সবকিছুই এখন তদন্তের টেবিলে। যারা মোটরসাইকেলে এসে হামলা করেছে, তারা হয়তো ভাড়াটে গুন্ডা। কিন্তু যারা তাদের পাঠিয়েছে, সেই ‘মাস্টারমাইন্ড’দের খুঁজে বের করাটা বেশি জরুরি। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স আদিব ট্রেডিং বা এসপি ট্রেডার্সের আড়ালে কারা কলকাঠি নাড়ছে, তা জনসমক্ষে উন্মোচন করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর এই হামলাকে কেবল ‘ব্যক্তিগত আক্রোশ’ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি রাষ্ট্রের আইনের শাসনের ওপর হামলা। এই হামলার বিচার যদি দৃষ্টান্তমূলক না হয়, তবে চোরাকারবারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। আমরা চাই, পপি বীজ বা ঘনচিনির মতো বিষ যারা দেশে ঢোকানোর চেষ্টা করে এবং যারা এই অপচেষ্টায় বাধা দেওয়া কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালায়, তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হোক। সৎ কর্মকর্তাদের পাশে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতেই হবে, নতুবা সততা পরাজিত হবে এবং দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন বিজয়ী হবে—যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।











































