সোমবার- ২৪ নভেম্বর, ২০২৫

খুনোখুনিতে চট্টগ্রামে বালু তোলা ও বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা

খুনোখুনিতে চট্টগ্রামে বালু তোলা ও বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা

# বিপাকে ব্যবসায়ী ও নির্মাণকাজে সংশ্লিষ্টরা
# রাতের আঁধারে থামছে না বালু তোলা ও বিক্রি
# থামছে না খুনোখুনি

খুনোখুনির কারণে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী থেকে বালু উত্তোলন, পরিবহন ও বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পুলিশ। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।

সোমবার (২৪ নভেম্বর) এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিএমপির উপকমিশনার (দক্ষিণ) মো. আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চাঁদাবাজি, সংঘর্ষ ও খুনের মতো ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৬ থানা এলাকায় বালু উত্তোলন, বিক্রি ও পরিবহন বন্ধ রাখতে সংশ্লিষ্ট সব থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করছে পুলিশ। এতে স্বস্তি ফিরে এসেছে কর্ণফুলী নদী তীরের বাসিন্দাদের মাঝে। তবে বিপাকে পড়ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারেরা।

ঠিকাদারেরা জানায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৬ থানা এলাকায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও মূলত বালুর ব্যবসা হয় কর্ণফুলী নদীসংলগ্ন সিএমপির তিন থানা বাকলিয়া, চান্দগাঁও ও কর্ণফুলীতে। বাকলিয়া থানার নতুন ব্রিজ, ক্ষেতচর এবং চান্দগাঁও থানার কালুরঘাট ও মোহরা এলাকায় রয়েছে একাধিক বালুমহাল ও বালু বিক্রয়কেন্দ্র।

শুধু কালুরঘাটেই বড় আকারের ৩-৪টি বালুমহাল ও বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। ছোট আকারের বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে আরও ডজনখানেক। তবে কর্ণফুলী নদীর রাঙ্গুনিয়া ও রাউজান অংশ থেকে তোলা বালু নগরীর এসব বিক্রয়কেন্দ্রে আসে। যার উপর পুরো নির্ভর চট্টগ্রাম মহানগরের নির্মাণ ও সংস্কার খাত। এ অবস্থায় প্রকাশ্যে বালু তোলা, পরিবহন ও বিক্রয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নগরীর বালু বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে বালুর দাম।

আরও পড়ুন :  জাল দলিলে নওজোয়ানের নামে আড়াই কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা প্রকল্পে নির্মাণকাজে যুক্ত ঠিকাদার রাশেদ এনাম জানান, আগে যেখানে প্রতি ঘনফুট বালুর দাম ছিল ২৩-২৫ টাকা, সেখানে বর্তমানে ৬০-৬৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আগে যত্রতত্র বালু পাওয়া যেত। কিন্তু এখন কোথাও বালু বিক্রি হচ্ছে না। কিনতে গেলে ট্রাকসহ থানায় নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। গোপনে কিছু জায়গায় বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আপাতত সেসব স্থান থেকে সংগ্রহ করে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি।

নগরের কালুরঘাটের বালু ব্যবসায়ী মো. হারুন বলেন, কালুরঘাট ও নতুন ব্রিজে এক সপ্তাহ ধরে বালু ব্যবসা বন্ধ। এতে আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছি। কালুরঘাটে একটি বালু বিক্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করেন হাসান বাদশা। তিনি বলেন, নতুন ব্রিজের বালুমহাল নিয়ে ঝামেলায় খুনোখুনি হয়েছে। তার বিস্তারিত জানা নেই। কিন্তু এখন আমরা যারা ছোট ব্যবসায়ী তাঁদের পেটে লাথি পড়েছে।

এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, পুলিশ বালু তোলা ও বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তা না মেনে রাতের আধাঁরে বালু উত্তোলন ও বিক্রি বা পরিবহন চলছে। এ সময় অনেককে আটক করে থানায়ও নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আবার তাদের ছেড়েও দেয়া হয়।

পুলিশ সূত্র জানায়, গত এক বছরে চট্টগ্রাম মহানগরী, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ায় বিভিন্ন ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই রাজনীতিসংশ্লিষ্ট। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, এসব হত্যাকান্ডের বেশির ভাগই ঘটেছে বালুমহালের বিরোধের জেরে।

এরমধ্যে সর্বশেষ খুনের ঘটনা ঘটে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা এলাকায়। গত ১৩ নভেম্বর রাতের আঁধারে রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সহসভাপতি আবদুল মান্নানকে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষ বালু ব্যবসায়ীরা।

আরও পড়ুন :  ইজারা প্রক্রিয়ার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বন্দর অবরোধের ডাক

পুলিশের নিষেধাজ্ঞার পর রাতের আঁধারে ড্রেজার দিয়ে কর্ণফুলী নদী থেকে বালু তোলার প্রতিবাদ করায় আবদুল মান্নানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আবদুল মান্নানের প্রতিবাদের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।

এর আগে চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ থানার খোন্দকারপাড়ায় ৫ নভেম্বর বিএনপির নেতা এরশাদ উল্লাহর নির্বাচনী গণসংযোগের সময় প্রতিপক্ষের গুলিতে মারা যান সরোয়ার হোসেন বাবলা। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, বালুমহাল, পাথর ব্যবসাসহ পূর্ববিরোধের জেরে তাঁকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই বালু ব্যবসা বন্ধের নির্দেশনা আসে। কিন্তু কয়েকদিন পর খুন হন আবদুল মান্নান।

এছাড়া গত ৭ অক্টোবর হাটহাজারীর মদুনাঘাট এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন বিএনপির নেতা আবদুল হাকিম। এ ঘটনায়ও রাউজানকেন্দ্রিক বালুমহালের বিষয়টি সামনে আসে। গত বছর নগরের চান্দগাঁও থানার শমসেরপাড়া এলাকায় দিনদুপুরে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী আফতাব উদ্দিন তাহসিন। ওই হত্যাকান্ডেও ইট ও বালু ব্যবসার বিরোধের যোগসূত্র পাওয়ার কথা জানায় পুলিশ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাকলিয়া থানার ওসি মো. আফতাব উদ্দিন বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পালাবদলের পর সন্ত্রাসীরা চট্টগ্রামে বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, ইট-বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিরোধে জেলাকে অস্থির করে রেখেছে। গত ১৪ মাসে ৪০টির মতো হত্যাকান্ড ঘটেছে। এরমধ্যে রাউজান উপজেলায় ১৭টি, রাঙ্গুনিয়ায় ৪টি ও চট্টগ্রাম শহরে ৪টি হত্যাকান্ড রাজনৈতিক ও আধিপত্য বিস্তারকে ঘিরে ঘটেছে।

এরমধ্যে গত বছরের ২৯ আগস্ট কুয়াইশ-অক্সিজেন সড়কে যুবলীগ কর্মী আনিস ও মাসুদকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২১ অক্টোবর চান্দগাঁওয়ে তাহসীনকে, চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি রাউজানের নোয়াপাড়া এলাকায় দিনদুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমকে, ২৯ মার্চ বাকলিয়া এক্সেস রোডে সরওয়ার বাবলার দুই সহযোগী মানিক ও রিফাতকে, ১১ এপৃল রাউজানে যুবদল কর্মী ইব্রাহিমকে, ২৩ মে পতেঙ্গায় ঢাকাইয়া আকবর, ২৫ অক্টোবর রাউজানে যুবদল কর্মী আলমগীর আলম গুলি করে হত্যা করা হয়।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে ব্যারাকের বাথরুম থেকে এএসআইয়ের লাশ উদ্ধার

পুলিশের বিভিন্ন সূত্র জানায়, বালু তোলা, পরিবহন ও বিক্রয়কে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে এক ডজন সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে আছে সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদ, রায়হান আলম, হাবিব খান, সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ, মোবারক হোসেন ইমন, শহিদুল ইসলাম বুইস্যা, ইসমাইল হোসেন টে¤পু, ফজল হক, মেজর ইকবাল, বিধান বড়ুয়া, আজিজ উদ্দিন ইমু ও আজিজুল হক। এর মধ্যে বড় সাজ্জাদ, হাবিব খান ও ফজল হক বিদেশে অবস্থান করলেও উপ-গ্রুপ দিয়ে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করছে।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলমান আছে। সম্প্রতি রাউজান নোয়াপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ দু‘জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা রাউজানের বিএনপি কর্মী আব্দুল হাকিম হত্যা মামলার আসামি। বাকি সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।

র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্নেল হাফিজুর রহমান বলেন, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। ওসব সন্ত্রাসীর ডাটা-তালিকা সবই আমাদের কাছে আছে। কিছু কিছু সন্ত্রাসী অপরাধ করে পাহাড়ি এলাকায় চলে যাচ্ছে। এ কারণে তাদের গ্রেপ্তারে সময় লাগছে।

ঈশান/মখ/বেবি

আরও পড়ুন

জনপ্রিয়

You cannot copy content of this page