শুক্রবার- ১১ এপ্রিল, ২০২৫

চট্টগ্রামের চালের বাজারের ত্রাতা উত্তরবঙ্গের সিন্ডিকেট চক্র!

চট্টগ্রামের চালের বাজারের ত্রাতা উত্তরবঙ্গের সিন্ডিকেট চক্র!

বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হচ্ছে চাল। দেশে উৎপাদিত চালও রয়েছে। সব মিলিয়ে শক্ত অবস্থানে চালের মজুত। এরপরও ব্যতিক্রম চট্টগ্রামের চালের বাজার। ক্ষণে ক্ষণে শুধুই বাড়ছে চালের দাম। এতে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে চট্টগ্রামের চালের বাজারে।

ভোক্তাদের প্রশ্ন, পর্যাপ্ত চাল মজুত থাকার পরও চালের দাম বাড়ছে কেন? অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্রের হাতে কি জিম্মী চট্টগ্রামের চালের বাজার? প্রশ্নের উত্তর মিলেছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। ব্যবসায়ীরা স্বীকার করেছেন, চট্টগ্রামের কোন ব্যবসায়ী নয়, উত্তরবঙ্গ সিন্ডিকেট চক্রই নিয়ন্ত্রণ করে চট্টগ্রামের চালের বাজার।

নগরীর পাইকারি চালের আড়ত পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ স¤পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রামের মানুষ ভাত খাই বেশি। তাও আবার চিকন আতপ চালের ভাত। সেই চাল চট্টগ্রামে তেমন উৎপাদন হয় না। উত্তরবঙ্গের চালকল বা চাতালগুলোতে চিকন ধান ব্যাপকহারে মজুত করা হয়। সেখানে একটা শক্ত সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। তারা সুযোগ বুঝে ধানের দাম যত বাড়ায় ততই চালের দাম বাড়ে। এমনকি বস্তা পাল্টিয়ে ব্র্যান্ডের নামে চালের দাম বাড়িয়ে চট্টগ্রামের বাজারে সরবরাহ করে। এটা একটা কারসাজি।

তিনি বলেন, ভারত যেমন সময় বুঝে আমাদের দেশে চাল রপ্তানি শুরু এবং বন্ধ করে। উত্তরবঙ্গের ওই সিন্ডিকেট ঠিক সেই পথ অনুসরণ করে চট্টগ্রামে চাল সরবরাহ করে। চট্টগ্রামের চাল ব্যবসায়ীদের জন্য উত্তরবঙ্গের ওই সিন্ডিকেট যেন একেকজন ভারতীয় ব্যবসায়ী। তারা সারাদেশে এক দামে চাল সরবরাহ করলেও চট্টগ্রামে সরবরাহ করে বেশি দামে। ফলে পুরো দেশের তুলনায় চট্টগ্রামে চিকন আতপ চালের দাম বেশি। আমদানি করায় অন্য চালগুলোর দাম তেমন বাড়াতে পারছে না।

একই কথা বলেছেন চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের খাদ্য পরিদর্শক (কারিগরি) ফখরুল আলমও। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে ধানি জমি কমছে ক্রমেই। বাড়ছে বসতি ও শিল্প-কারখানা। এতে চাল সংকট এলাকায় পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম। ফলে বিভিন্ন দেশ ও উত্তরবঙ্গ থেকে চাল এনে এই খাদ্য সংকট পূরণ করা হয়। কিন্তু চিকন আতপ চালের চাহিদা মেটাতে উত্তরবঙ্গ থেকে প্রতিদিন ৬০-৭০ ট্রাক চাল আনা হয় চট্টগ্রামে।

আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চাল সরবরাহে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন উত্তরবঙ্গের চাল ব্যবসায়ীরা। তারা সারাদেশে একদামে চাল সরবরাহ করলেও চট্টগ্রামে সরবরাহ করে ভিন্নদামে। ফলে পুরো দেশের তুলনায় চট্টগ্রামে চালের দাম সবসময় বেশি থাকে। সর্বশেষ গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রামে তিন জাতের চিকন আতপ চালের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৩০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত।

বিষয়টি নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই চট্টগ্রামের চাল ব্যবসায়ীদের। যারা প্রায় সময় প্রশাসনের অভিযানিক দলকে বলেন, এখানে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করে লাভ কি? উত্তরবঙ্গের পাইকারি আড়ত বা মোকামগুলোতে অভিযান চালান। তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনেন। তাহলে চালের দাম কমবে।

শুক্রবার (৪ এপ্রিল) চট্টগ্রামের চাক্তাই ও পাহাড়তলী পাইকারি চালের আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, চাহিদা থাকায় জিরাশাইল, নাজিরশাইল ও কাটারি আতপ জাতের চাল চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি জিরাশাইল ৭৬ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হয়েছে ৮৪ টাকায়। নাজিরশাইল কেজিপ্রতি ৭৮ টাকা থেকে বিক্রি হচ্ছে ৮৮ টাকায়। কাটারি আতপ ৭৬ টাকা থেকে বিক্রি হচ্ছে ৮৬ টাকায়। বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) এই তিন জাতের চালে বেড়েছে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।

পাইকারিতে দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। বর্তমানে খুচরায় প্রতি কেজি নাজিরশাইল ৯২ টাকা, জিরাশাইল ৯০ টাকা ও কাটারি আতপ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইজার আতপ ৭৮ টাকা, মিনিকেট আতপ ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় আরও অনেক কম দামে বিক্রয় হচ্ছে এসব চাল। এ নিয়ে ক্রেতাদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে ।

চট্টগ্রাম রাইস মিল সমিতির সভাপতি মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রামের মানুষ সেদ্ধ চাল খাই না, আতপ চাল খাই। যা আমদানিও করা যায় না, এমনকি চট্টগ্রামেও তেমন উৎপাদন হয় না। চট্টগ্রামে ধানি জমি কমে যাওয়ায় আতপ চালের উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে দেশের উত্তরবঙ্গ, সিলেট, ব্রহ্মাণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নওগাঁ, বগুড়া, দিনাজপুর থেকে চাল আনা হয়।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামে চালের পাইকারি বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি করার কোন সুযোগ নেই। কারণ চট্টগ্রামে ৮০ শতাংশ চাল আসে উত্তরবঙ্গ থেকে। ওসব স্থানেই মূলত দাম বাড়া-কমার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ হয়। সেখানে নজরদারি বাড়ালে হয়তো দাম কমে আসবে।

এদিকে খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চট্টগ্রামে সরকারি খাদ্য গুদামে খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চালের মজুত আছে এক লাখ ২৮ হাজার ৫৮৫ মে. টন। গম মজুত রয়েছে ৩৬ হাজার ৫৭৫ টন। গত বছর (২০২৪ সাল) একই সময়ে খাদ্য মজুত ছিল ৮১ হাজার ৩২২ টন। চাল ছিল ৭০ হাজার ৯৮১ টন। গম ছিল ১০ হাজার ২৯৯ টন।

সরকারের আমদানি পরিস্থিতির তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ভারত, মায়ানমার, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৪২৫ টন চাল আমদানি হয়েছে। সে হিসেবে দেশে খাদ্য মজুত রয়েছে ১৫ লাখ ১৮৩ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল মজুত আছে ১০ লাখ ৮০ হাজার ২৬৭ টন। গম মজুত আছে ৪ লাখ ১৩ হাজার ৯৪৪ টন।

চট্টগ্রাম চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রক জ্ঞানপ্রিয় বিদূষী চাকমা বলেন, সরকার ৯-১০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যেই লক্ষাধিক টন খাদ্যশস্য দেশে পৌঁছেছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে চারটি জাহাজ থেকে আমদানি করা চাল খালাস করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম মহানগরের হালিশহর এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলামের ভাষ্য, সরকার এত চাল আমদানি করে লাভ কি হলো। সিন্ডিকেট চক্র তো এখনো সক্রিয়। নানা অজুহাতে তারা বাজার অস্থির করার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনকে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দূর হবে না।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, মজুত বৃদ্ধির পরও চালের দাম বাড়তি, এটা খুব দুঃখজনক। চট্টগ্রামে দেশের যে অঞ্চল থেকে চাল আসে সেখানে নজরদারি বাড়াতে হবে। মিলারদের কাছে ধান কী পরিমাণ মজুত আছে, দেখতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাহলে চালের বাজার দর কমে আসতে পারে।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page