
# ছড়িয়ে পড়েছে বহুজনের ছবি
# ফ্রিজে সংরক্ষিত আহত মামুনের খুলি
# জ্ঞান ফেরেনি ইমতিয়াজ আহমেদ সায়েমের
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত ৯ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। এছাড়া অস্ত্রধারী আরও অনেকের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যাদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে এ তথ্য জানান হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মো. তারেক আজিজ। তিনি বলেন, ঘটনায় অভিযুক্ত মামলার এজাহার মোতাবেক এ পর্যন্ত আমরা আটজনকে গ্রেফতার করেছি। এছাড়া হামলায় অংশ নেওয়া যাদের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে তাদের ইতোমধ্যে আমরা শনাক্ত করেছি। এই ব্যক্তিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি হামলায় কিছু ব্যক্তি মাস্ক পরে অংশ নিয়েছিলেন, তাদেরও শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
সূত্র মতে, চবির এক ছাত্রীকে ভাড়া বাসায় দারোয়ানের মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত শনিবার দিনগত রাত ও রবিবার দিনব্যাপী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় গ্রামবাসীর সংঘর্ষ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই সংঘাতে কয়েকশ শিক্ষার্থী আহত হন। এর মধ্যে বেশিরভাগ চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছাড়লেও কয়েকজনের অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক।
জ্ঞান ফেরেনি ইমতিয়াজ আহমেদ সায়েমের
চট্টগ্রাম মহানগরীর বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালের শয্যায় নিথর পড়ে আছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ইমতিয়াজ আহমেদ সায়েম। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, মাথায় মোটা ব্যান্ডেজ। পাশে মনিটরের টুকটাক শব্দ।
গত রোববার শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসীর মধ্যকার ঘটে যাওয়া এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতে তিনি গুরুতরভাবে আহত হন। মাথায় পড়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। চিকিৎসকরা তার মাথায় জরুরি অস্ত্রোপচার করেন। এরপর কেটে গেছে পাঁচদিন, তবুও জ্ঞান ফেরেনি সায়েমের। বর্তমানে তিনি নগরীর পার্কভিউ হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে আছেন। অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সায়েমের বাড়ি কুমিল্লায়। তবে তার পরিবার থাকে বগুড়ায়।
ছেলে আহত হওয়ার খবর পেয়ে সেখান থেকে গত সোমবার সকালে তার বাবা আমির হোসেন ও মা শাহনাজ আমিন চট্টগ্রামে আসেন। ছেলে সুস্থ হয়ে ফিরবেন, সেই অপেক্ষায় আইসিইউর সামনে দিন কাটছে তাদের।
ইমতিয়াজের ভাই আসাদুজ্জামান সজীব বলেন, বুধবার সায়েমের সিটিস্ক্যান পরীক্ষায় রক্তক্ষরণ ধরা পড়েছে। মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে চিকিৎসকরা বলেছেন, অপারেশন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আমাদের সম্মতি পেলে রাতেই অপারেশন হবে। সুস্থ-সবল ছেলেটির এই পরিণতির পেছনে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় গ্রামবাসী মোহাম্মদ নোমান নামের এক তরুণ ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে।
সায়েমের বন্ধু ও প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেন, এই নোমান আর তার সঙ্গীরাই কুপিয়েছে সায়েমকে। নোমানের বাড়ি ফতেহপুর ইউনিয়নে। তিনি ছাত্রলীগের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত আছেন বলে জানা গেছে। ঘটনার দিন সংঘর্ষে অংশ নেওয়া নোমানের ছবি প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ফেসবুক পেজ দ্য বিউটি অব সিইউ ক্যাম্পাস।
ফ্রিজে সংরক্ষিত মামুনের খুলি
সায়েমের সঙ্গে একই সংঘাতে আহত হয়েছেন সমাজতত্ত্ব বিভাগ অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র মামুন মিয়া। তার মাথার খুলি ফেটে যাওয়ায় অস্ত্রোপচারে খুলির একটি অংশ ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। তবে মামুনের অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে।
তার বড় ভাই টাঙ্গাইলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাসুদ রানা বলেন, মামুন আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারছে। বুধবার বিকেল ৫টায় তাকে কেবিনে স্থানান্তর করেছেন।
পার্কভিউ হাসপাতালের স্পেশালাইজড ইউনিটের ইনচার্জ ডা. সিরাজুল মোস্তফা বলেন, সায়েমের মাথায় ধারালো অস্ত্রের গভীর ক্ষত ছিল। খুলির ভেতরের অংশ ও রক্তনালী ছিঁড়ে গেছে। এখন পর্যন্ত তার জ্ঞান ফেরেনি। শুধু ব্লাড প্রেসারে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে আমরা অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
মামুনের বিষয়ে তিনি জানান, তার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। খুলি ফ্রিজে রাখা হয়েছে। যদি সুস্থ থাকে, দুই থেকে আড়াই মাস পর তা পুনঃস্থাপন করা হবে।
গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা হলেন নিউরোসার্জন ডা. মো. ইসমাইল, অধ্যাপক ডা. মনজুরুল ইসলাম, নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. তায়েব, হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. রেজাউল করিম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা, এটিএম রেজাউল করিম ও আইসিইউ ইনচার্জ ডা. মো. সাজ্জাদ হোসাইন।
চিহ্নিত ৯ অস্ত্রধারী
শুধু সায়েম বা মামুন নয়, সেদিন শত শত শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। যাদের মধ্যে নোমান ছাড়াও আরও ৮ জনের নাম ও ছবি প্রকাশ করেছে ফেসবুক পেজ দ্য বিউটি অব সিইউ ক্যাম্পাস। যারা সবাই ওইদিন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
এছাড়া চিহ্নিত না হওয়া প্রায় শতাধিক যুবকের ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে, তাদের নাম পরিচয়ের জন্য সবার সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। চবির এক ছাত্রীকে ভাড়া বাসায় দারোয়ানের মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত শনিবার রাত ও রবিবার দিনব্যাপী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই শিক্ষার্থী-স্থানীয় সংঘাতে কয়েকশ শিক্ষার্থী আহত হন। এর মধ্যে বেশিরভাগ চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছাড়লেও কয়েকজনের অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সেদিন স্থানীয় সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর রামদা, কাস্তে, লোহার রডসহ নানা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালান। হামলার সময় ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ভিডিওতে শিক্ষার্থীদের এলোপাতাড়ি কোপাতে দেখা যায়। আক্রোশের এখানেই শেষ নয়, দু‘জন শিক্ষার্থীকে মেরে ছাদ থেকে ফেলেও দেন সন্ত্রাসীরা।
এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দফতরের প্রধান আব্দুর রহিম বাদী হয়ে হাটহাজারী মডেল থানায় ৯৫ জনের নাম উল্লেখ ও এক হাজার ব্যক্তিকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করেছেন। মামলায় এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর বাইরে হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া ওই নয়জনকে চিহ্নিত করেছে দ্য বিউটি অব সিইউ ক্যাম্পাসে নামের পেজটি।
নয়জনের নাম-পরিচয়
নোমানের কথা তো আগেই বলা হলো। নাম-পরিচয় পাওয়াদের আরেকজন হলেন মো. ফয়সাল। ঘটনার দিন ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে তাকে রামদা নিয়ে কোপাতে দেখা যায়। এই যুবক আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তখনকার বিভিন্ন ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে।
আরেকজনের নাম এমএইচ জনি। তিনি হাটহাজারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়েন। ঘটনার দিন এই তরুণ জোবরার ইমাম বুখারী গলিতে হামলায় অংশ নেওয়া দলটির নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই তরুণের ফেসবুক আইডিও প্রকাশ করা হয়েছে। তবে প্রকাশ করা ওই আইডিতে আর ঢোকা যাচ্ছে না।
হামলার দিন বড় পাথর দিয়ে এক ছাত্রকে মাথায় থেঁতলাতে দেখা গেছে একদল যুবককে। সেই দলে ছিলেন মো. মাসুদ। জোবরা ফ্রেন্ডস সার্কেল নামের একটি দলের সদস্য তিনি। তিনি একসময় উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হামলার সময় তাকে খুবই আগ্রাসী অবস্থায় দেখা গেছে।
শিক্ষার্থীদের ওপর শনিবার রাতে সবার আগে হাত তোলার অভিযোগ উঠেছে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকের বিরুদ্ধে। ছবিতে হামলার সময় তাকে লাঠি হাতে দেখা গেছে, তবে তার নাম এখনও পাওয়া যায়নি। হামলায় গুরুতর আহত হয়ে এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নাইমুল ইসলাম। তাকে কোপান কয়েকজন।
তাদের মধ্যে রামদা হাতে কোপানো একজনের স্পষ্ট ছবি প্রকাশ হয়েছে। ঘটনার শুরুতে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক মারধর করেন মো. মিজান নামের এক যুবক। পরদিনও তিনি হামলায় অংশ নেন।
হামলার সময় লোহার রড হাতে দেখা গেছে সাইফুল ইসলামকে। তিনিও ফতেপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। হামলার সময় রামদা হাতে একটি দলের নেতৃত্ব দেন মো. ফারুক নামের আরেক যুবক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেট এলাকার একটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানি, যে দোকানের ক্রেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই। হামলায় অংশ নেওয়া এসব ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ঈশান/মখ/বেবি