Skip to content

সোমবার- ২ জুন, ২০২৫

জিয়া নয়, সেদিন দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে হত্যা করা হয়েছিল

জিয়া নয়, সেদিন দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে হত্যা করা হয়েছিল

১৯৮১ সালের ৩০ মে দলীয় সফরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণার মধ্য দিয়ে যার হাত ধরে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সে হিসেবে জিয়া নয়, সেদিন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হত্যা করেছিল তারা।

তারা কারা? তারা হলেন বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য। তারা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। তাহলে তারা স্বাধীনতার ঘোষক জাতীয়তাবাদী এই নেতাকে হত্যা করেছিল কিভাবে? তাদের উদ্দেশ্য, পরিষ্কার। বাংলাদেশকে সেবাদাসে পরিণত করার লক্ষ্যে দেশকে পরনির্ভরশীল একটা রাজ্যে পরিণত করার জন্য সেদিন এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল।

যার বিস্তারিত বর্ণনা উঠে এসেছে চট্টগ্রামের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) জিয়াউদ্দিন চৌধুরীর লেখা আত্নস্মৃতিমূলক গ্রন্থ অ্যাসাসিনেশন অব জিয়াউর রহমান অ্যান্ড আফটারম্যাথ গ্রন্থে। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ তাঁর একটি প্রবন্ধেও ওই রাতের ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেছেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যাকান্ডের ওপর রচিত বিভিন্ন বইপত্র ও ইতিহাস গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রামে বিএনপির দুটি পক্ষের অন্তর্কোন্দল মেটাতেই জিয়াউর রহমান সেদিন ইরাক ও ইরানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সফর বাতিল করে চট্টগ্রাম সফরে গিয়েছিলেন। সফরের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে বিষয়টি জানানো হয় চট্টগ্রামের ডিসি জিয়াউদ্দিন চৌধুরীকে। যদিও এর আগে এ ধরনের সফরের কথা প্রায় মাসখানেক আগে ডিসিকে জানানো হতো।

এই অল্প সময়ের মধ্যেই ডিসি সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং তার সফরসঙ্গীদের থাকার ব্যবস্থা করেন। ওই সফরে জিয়ার সফরসঙ্গী ছিলেন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, উপ-প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দিন আহমেদ, আমেনা রহমানসহ দলের আরো কিছু নেতা।

২৯ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে চট্টগ্রাম পৌঁছান জিয়াউর রহমান। বিমান বন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান বিভাগীয় কমিশনার সাইফউদ্দিন, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বদিউজ্জামান, ডিআইজি শাহজাহান এবং ডিসি জিয়াউদ্দিন। বিএনপির কিছু নেতা এবং তিন বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডাররাও সেখানে ছিলেন।

তবে সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জিওসি মেজর জেনারেল মনজুর সেদিন উপস্থিত ছিলেন না। তার পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজিজ। রাষ্ট্রপতি জিয়া জিওসি মনজুরের না আসার কারণ জানতে চাইলে তাকে জানানো হয়, টেনিস খেলে কিছুটা আহত হওয়ায় জেনারেল মনজুর উপস্থিত থাকতে পারেননি।

বিমান বন্দর থেকে জিয়া সরাসরি চলে যান ভিআইপি লাউঞ্জের বাইরে রাষ্ট্রপতির জন্য অপেক্ষায় থাকা গাড়ি বহরের দিকে। ডিসি জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে তার টয়োটা করোলায় চড়ে সার্কিট হাউসের দিকে রওনা হন তিনি। সার্কিট হাউসে ঢুকেই তিনি কারও সঙ্গে কথা না বলে সোজা চলে যান তার জন্য নির্ধারিত রুমে। জুম্মার নামাজ আদায় করার জন্য তিনি অত্যন্ত গম্ভীরমুখে বের হয়ে চন্দনপুরা মসজিদের উদ্দেশে রওনা হন। সেসময় তার সঙ্গে ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার।

মসজিদ থেকে ফিরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জানান, ডিআইজি ও পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করবেন যেখানে বিভাগীয় কমিশনার এবং ডিসিও থাকবেন। তবে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা বললেও রাষ্ট্রপতি জিয়া দুপুরের খাবার সেরেই দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন।

সন্ধ্যা সাতটার দিকে কর্মকর্তারা সার্কিট হাউসে এসে জানতে পারেন, রাষ্ট্রপতি দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। কর্মকর্তাদের যে দেখা করতে বলেছিলেন তা সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন জিয়া। ৩ ঘণ্টা অপেক্ষার পর রাত ১০টার দিকে কমিশনার ওপরে উঠে জানতে পারেন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং হবে না। মিটিং না হওয়ায় তখনই কর্মকর্তারা যে যার বাড়ি ফিরে যান।

দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দুপুরে শুরু হওয়া বৈঠক মাঝে রাতের খাবারের বিরতি দিয়ে চলে মাঝরাত পর্যন্ত। বৈঠক শেষে রাষ্ট্রপতি ও তার সফরসঙ্গীরা যে যার রুমে যান ঘুমাতে। সেসময় সার্কিট হাউসের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা বাহিনীর দু‘জন ছিলেন রাষ্ট্রপতির দরজার দুই পাশে। বাইরে প্রহরায় ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। ডিসির সহকারী প্রটোকল অফিসারও ছিলেন সার্কিট হাউসে কর্তব্যরত।

নিজের সেই প্রটোকল অফিসারকে উদ্ধৃত করে জিয়াউদ্দিন তার বইতে লিখেছেন: ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোর চারটার দিকে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিকট আওয়াজে ঘুম ভাঙে প্রটোকল অফিসারের। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখেন তার সামনের বারান্দার (সার্কিট হাউসের) কিছু অংশ ঝুলে পড়েছে। খুব সম্ভব কোন শেল আঘাত করেছে।

খাবার ঘরের জানালা দিয়ে তিনি দেখলেন, সার্কিট হাউসের গেট দিয়ে সামরিক বাহিনীর যান ঢুকছে। সেখান থেকে লাফিয়ে নামছে সৈন্যরা এবং গুলি করছে পুলিশকে লক্ষ্য করে। পুলিশ কোন প্রতিরোধ করেনি। কারণ প্রতিরোধ বৃথা তারা তা বুঝতে পেরেছিলেন। ডাইনিং রুমের টেবিলের নিচে লুকিয়ে থাকা প্রটোকল অফিসার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাষ্ট্রপতির ঘরের দিকে যাওয়া সৈন্যদের বুটের আওয়াজ শুনতে পান। সেখান থেকে ভেসে আসে গুলির শব্দ, আর্তচিৎকার।

প্রটোকল অফিসারের মতে, প্রায় একঘণ্টা এই তান্ডব চলার পর সেনাবাহিনীর গাড়িগুলো সার্কিট হাউস ছেড়ে যায়। তিনি খাবার ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখেন, সামনে পড়ে আছে রাষ্ট্রপতির গার্ডের একজনের মৃতদেহ। চারদিকে ধ্বংসের চিহ্ন, রক্ত। এ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে পেছনের দরজা দিয়ে প্রটোকল অফিসার পালিয়ে আসেন সার্কিট হাউসের পাশে ট্রান্সপোর্ট পুলে।

গুলি ও মেশিনগানের শব্দে আতঙ্কিত পাহারাদারের হাঁকডাকে ভোর চারটার দিকে যখন ডিসি জিয়াউদ্দিনের ঘুম ভাঙে, টেলিফোনে এই অফিসারের কাছ থেকেই তিনি সার্কিট হাউসে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রথম বর্ণনা শোনেন। তবে রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হয়েছেন কিনা সে স¤পর্কে কিছু জানাতে পারেননি প্রটোকল অফিসার। এর কিছুক্ষণ পর বিভাগীয় কমিশনার ডিসিকে ফোন করে লে. কর্নেল মাহফুজের বরাত দিয়ে জানান রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন।

ডিসি জিয়াউদ্দিন নিজে গাড়ি চালিয়ে বিভাগীয় কমিশনার সাইফউদ্দিনকে পথ থেকে তুলে নিয়ে যখন সার্কিট হাউসে পৌঁছান তখন ভোরের আলো ফুটেছে। সেখানে আগেই উপস্থিত হয়েছিলেন ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার এবং এসপি। তারা দেখতে পান, দেয়ালে গুলির দাগ, গোলার আঘাতে উড়ে গেছে ছাদের একটা অংশ, কাঠের টুকরো পড়ে আছে গাড়িবারান্দায়। সেখানে প্রচুর রক্ত।

দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার তাদেরকে জানান, প্রাথমিকভাবে বাইরে থেকে সশস্ত্র সৈন্যদের একটি কনভয় এবং পরে ভেতর থেকে সৈন্যের দল সার্কিট হাউস আক্রমণ করে। তারপর চালায় মেশিনগান। রাষ্ট্রপতির রুম লক্ষ্য করে রকেট শেল ছোড়া হয় কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ছাদে আঘাত হানে। ফলে ছাদের একটি অংশ ভেঙে পড়ে। পুলিশ পাল্টা গুলি ছুড়েছিল। কিন্তু প্রতিরোধ করতে পারেনি। আক্রমণকারীরা ঢুকে যায়। ভেতরে তারা রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাবাহিনীর গার্ড এবং পুলিশের সম্মুখীন হয়। গাড়ি বারান্দায় রাষ্ট্রপতির একজন গার্ড এবং একজন পুলিশ কনস্টেবল নিহত হন। গাড়ি বারান্দার রক্ত তাদেরই।

আক্রমণকারীরা রাষ্ট্রপতি জিয়ার রহমানের রুমের দরজায় পদাঘাত করলে জিয়া দরজা খোলেন এবং মুহূর্তেই গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যান। অন্যদিকে আরেকটি দল জিয়ার নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল আহসানের রুম খুঁজে তাকে হত্যা করে। তিনি জিয়ার রুম থেকে কয়েকটি রুম পরে ছিলেন। এখানেও একজন গার্ড এবং একজন কনস্টেবলের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

এসপি এবং ¯েপশাল ব্রাঞ্চের একজন অফিসারকে নিয়ে জিয়াউদ্দিন দোতলায় উঠে দেখেন রাষ্ট্রপতির রুমের সামনে একটি মৃতদেহ পড়ে আছে রক্তের মাঝে। শরীরটি সাদা চাদরে ঢাকা। মৃতদেহটি পাহারা দেওয়া রাষ্ট্রপতির একজন গার্ড তাদের বলেন: স্যার ইনি রাষ্ট্রপতি জিয়া।

এরপরে রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গীদের খোঁজ করেন ডিসি জিয়াউদ্দিন। তাকে দেখে কক্ষ ছেড়ে বের হন পাংশুবর্ণ বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আমেনা রহমান এবং অন্যরা। আক্রমণের সময় তারা টয়লেট বা বিছানার তলায় লুকিয়ে ছিলেন। ডিসি তাদের রেস্ট হাউসে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

তবে সার্কিট হাউস থেকে ইউনিফর্ম পরে বের হওয়া লে. কর্নেল মাহফুজের ব্যবহার অবাক করার মতো ছিল বলে লিখেছেন জিয়াউদ্দিন। তিনি লিখেন, আমি যখন কমিশনার ও অন্য পুলিশ অফিসারদের জটলার দিকে এগোচ্ছিলাম তখন দেখলাম ওয়্যারলেস সেট হাতে পুরো ইউনিফর্ম পরে লে. কর্নেল মাহফুজ বের হচ্ছেন সার্কিট হাউস থেকে।

জটলা থেকে ৫০ গজ দুরে দাঁড়িয়ে তিনি ওয়্যারলেসে কথা বলছিলেন। কথা শেষ করে তিনি জটলার কাছে এসে জানালেন, তিনি (লে. কর্নেল মাহফুজ) সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি তাদের জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীতে অনুপ্রবেশকারীরা রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে। তাদের তিনি জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির মরদেহ ঢাকায় নেওয়ার বন্দোবস্ত করতে। মাহফুজের মতে, জেনারেল এরশাদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে যেকোন সময় হেলিকপ্টারে করে পৌঁছাতে পারেন।

মাহফুজের ভাবলেশহীন অবস্থার বর্ণনা দিয়ে জিয়াউদ্দিন লিখেছেন, লে. কর্নেল মাহফুজের মধ্যে কোন উত্তেজনা ছিল না, বেশ শান্ত দেখাচ্ছিল। ঘটনাবলীর বিবরণও তিনি দিলেন না। শুধু বললেন, আক্রমনকারীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। কিন্তু তিনি বিছানার নিচে আশ্রয় নিয়ে বেঁচেছেন। পরে জিয়াউদ্দিন সেখানে গুলির দাগ দেখেছিলেন বটে, তবে সেগুলো ছিল পেছনের দেয়ালে, দরজায় গুলির কোন আঘাতের চিহ্ন ছিল না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ একটি প্রবন্ধে ওই রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ৩০ মে ভোর রাতে সার্কিট হাউসে হামলার পরিকল্পনা করায় এবং হত্যাকান্ড ঘটার পর সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন দু‘জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার। একজন হলেন চট্টগ্রাম ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টার্সের সিনিয়র স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান। অপরজন ২১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহবুবুর রহমান। মেহবুব ছিলেন জেনারেল মঞ্জুরের আপন ভাগ্নে।

বিভিন্ন অফিসারের বর্ণনায় জানা যায়, তাদের বলা হয়েছিল প্রেসিডেন্টকে সার্কিট হাউস থেকে তুলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে নিয়ে আসা হবে, বিভিন্ন দাবি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, জিয়ার নিরাপত্তায় নিয়োজিত অফিসার ও সেনাসদস্যদের সঙ্গে হামলাকারীদের গোলাগুলি শুরু হওয়ার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি জিয়া তাঁর কক্ষ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন। তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান খুব কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে এক ঝাঁক গুলি করে জিয়াকে হত্যা করেন।

এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় সারাদেশের মানুষ ক্ষোভ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে সকালের আলো ফোটার আগেই তার মরদেহ সরিয়ে ফেলা হয়। ইতিহাসের নিকৃষ্ট ঘাতকচক্র পালানোর পথ খুঁজে নিতে তড়িঘড়ি করে শহীদ জিয়ার মরদেহ নেয় চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা এলাকায়। যা এখন জিয়া নগর হিসেবে পরিচিত।

সকালে লাশ দাফনের সময় সেনা সদস্যরা সাথে নেয় পাশের কয়েকজন গ্রামবাসীকে। অস্ত্রের মুখে তাদের হুমকি দেওয়া হয় বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য। এ কথা জানালে পরিবার পরিজনসহ হত্যারও হুমকি দেওয়া হয়। অস্ত্রের মুখে কবর খোড়া ও দাফন কাজে জড়িতদের একজন ছিলেন স্থানীয় তালেব ফকির। চট্টগ্রাম থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে রাঙ্গুনিয়ার পোমরার পাহাড়ি এলাকায় তড়িঘরি করে দাফন করা হয়েছিলো শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মরদেহ। হত্যার পর ঘাতকরা মনে করেছিলো, পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলে পুতে রাখলেই দেশের মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা যাবে তাদের প্রিয় নেতাকে।

কিন্তু সকাল শেষ না হতেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ওইদিন বেলা বাড়তেই রাউজানের পাহাড়তলী চৌমুহনী বাজারে চায়ের দোকানে রুটি বানানোর কাজে ব্যস্ত ছালামত উল্যাহ বদি। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো মাটি খোড়ার কথা বলে। পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলের মাটি খুড়ে তুলে এনেছিলো শহীদ জিয়ার লাশ। রাঙ্গুনিয়ায় জিয়ার লাশ দাফন করা হয়েছে। তা তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই দৃশ্য দেখতে উৎসুক হাজারো মানুষের মতো এসেছিলেন সেদিনের তরুণ এনামূল হক তালুকদার। তিনি জানান, তিনটি লাশ ছিলো একই কবরে।

একই কথা বলেন, প্রয়াত বিএনপি নেতা ক্যাপ্টেন ডাক্তার এম এন ছাফাও। তিনটি লাশ কবর থেকে তুলে আনা হয় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। সবার মরদেহ ছিলো একই পলিথিনে মোড়ানো। কবরে যেভাবে ছিল, ঠিক একই অবস্থায় তাদের তুলে আনা হয়। দুপুরে ক্যান্টনমেন্টের গেইটে জড়ো হন হাজার হাজার মানুষ। জিয়াভক্ত এসব মানুষকে সামাল দিতে হিমশিম খায় সেনা সদস্যরা।

বিকাল পৌনে ৪টায় বিমান বাহিনীর একটি বিমানে চট্টগ্রাম থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ ঢাকায় নেওয়া হয়। তার কফিনটি প্রেসিডেন্ট ভবনে আনার পর সেখানে বেগম খালেদা জিয়া, তার দুই ছেলে তারেক রহমান পিনু এবং আরাফাত রহমান কোকোসহ অন্য আত্নীয়-স্বজন সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখান থেকেই তারা জিয়াউর রহমানকে শেষ বিদায় দেন।

জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিকে মধ্যপন্থী উদার দল হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপির নীতি-আদর্শ বিবেচনা করলে দেখা যাবে, ইউরোপের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের রাজনীতির দর্শন এখানে প্রয়োগ করেছিলেন জিয়াউর রহমান।

তিনি বাকশালের একদলীয় শাসনের পরিবর্তে ফিরিয়ে আনেন বহুদলীয় গণতন্ত্র। এমনকি বাকশালে বিলুপ্ত হওয়া আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেন তিনি। পাশাপাশি অন্যান্য দলকেও রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান জামায়াতকে রাজনীতি করার যেমন সুযোগ দিয়েছিলেন, তেমনি বিলুপ্ত আওয়ামী লীগকেও বাকশালের গহ্বর থেকে তুলে এনেছিলেন।

১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। আর ১৩ দিনের মাথায় শহীদ হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। শেখ হাসিনা তার শাসনামলে শহীদ জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের খেতাব কেড়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু দেশের পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রায় সকল নেতাকর্মী এখন পলাতক। আর চরম দমন, নির্যাতনের মুখেও জিয়াউর রহমানের হাতেগড়া দল টিকে গেলো হিমালয় সমান বাধাকে মোকাবিলা করে। এর কারণ জিয়াউর রহমানের নীতি ও উদারপন্থী রাজনৈতিক দর্শন।

লেখক : একজন গণমাধ্যমকর্মী ও মানবাধিকার গবেষক

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show

জনপ্রিয়

You cannot copy content of this page