
# ভুগর্ভস্থ পাইপলাইনে তেল গেল ঢাকায়
# বছরে সাশ্রয় হবে ২৩৬ কোটি টাকা
# কমবে চুরি ও সিস্টেম লস
জ্বালানি তেল পরিবহনে নতুন যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। নিরাপদ ও দ্রুত সময়ে চট্টগ্রাম থেকে ভুগর্ভস্থ পাইপলাইন দিয়ে সরাসরি জ্বালানি তেল পৌঁছে গেল ঢাকায়।
শনিবার (১৬ আগস্ট) সকালে এ যুগের সুচনা ঘটে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। নগরীর পতেঙ্গা গুপ্তাখালে পদ্মা অয়েল কো¤পানির ডেসপাস টার্মিনাল থেকে ভুগর্ভস্থ পাইপলাইনে সরাসরি জ্বালানি তেল সরবরাহের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ স¤পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।
জ্বালানি সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশনের প্রধান মেজর জেনারেল মুহাম্মদ হাসান উজ জামান প্রমুখ এ সময় উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন।
ফাওজুল কবির খান বলেন, মাটির নিচ দিয়ে সরাসরি জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশের জ্বালানি খাত নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। কারণ এই ব্যবস্থায় খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরাপদে ঢাকায় জ্বালানি তেল সরাবরাহ দেওয়া সম্ভব হবে।
ফাওজুল কবির খান আরও বলেন, আগে নৌপথে অয়েল ট্যাংকারে ঢাকায় যেতে যেখানে ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগতো, এখন সেখানে সময় লাগবে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এতে সময় বাচবে ৩৬ ঘন্টা। সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খরচও সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি সিস্টেম লস ও চুরি প্রায় শূন্যে নামবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের উপ-ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) শ্যামল পাল জানান, ঢাকায় প্রতিবছর ৫ মিলিয়নের মতো জ্বালানি পরিবহন করা হতো চট্টগ্রাম থেকে। এতে প্রতি মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে জলপথে জ্বালানি পরিবহনের জন্য ১১০টিরও বেশি অয়েল ট্যাংকারের প্রয়োজন হয়। একেকটি ট্যাংকার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ডিপোতে পৌছতে ৪৮ ঘন্টা সময় লাগে। এতে পরিবহনে বিপিসির বার্ষিক খরচ হতো প্রায় ৩২৬ কোটি টাকা।
কিন্তু পাইপলাইন চালু হওয়ার পর খরচ নেমে আসবে মাত্র ৯০ কোটি টাকায়। তেলও পৌছে যাবে ১২ ঘন্টায়। এতে বছরে অন্তত ২৩৬ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এছাড়া সিস্টেম লস এবং চুরি ঠেকানোর মাধ্যমেও খরচ সাশ্রয় হবে।
শ্যামল পাল আরও জানান, পাইপলাইনটির বার্ষিক পরিবহণ ক্ষমতা ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন থেকে ৩ মিলিয়ন মেট্রিকটন। ভবিষ্যতে পাঁচ মিলিয়ন মেট্রিকটন পর্যন্ত পরিবহন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ মেট্রিকটন তেল পরিবহনের সক্ষমতা আছে এ পাইপলাইনের।
পেট্রোলিয়াম ট্রান্সমিশন কো¤পানির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্ল্যানিং অ্যান্ড অপারেশন্স) জামান নাহীদ রায়হান বলেন, আগে তেলবাহী ট্যাংকারের মাধ্যমে নৌপথে জ্বালানি তেলের বড় অংশ পরিবহণ করা হতো। যেখান থেকে প্রায়ই চুরি হতো বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল। এছাড়া খারাপ আবহাওয়ার কারণে নৌপথে ট্যাংকারে তেল পরিবহন বিঘ্নিত হতো, সৃষ্টি হতো ঝুঁকির। এই পাইপলাইন সে সমস্যার সমাধান করে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমরা নতুন স্থাপিত এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রাক কমিশনিং সম্পন্ন করেছি। কোনো ধরনের সিস্টেম লস ছাড়াই প্রায় পাঁচ কোটি লিটার ডিজেল আমরা সরবরাহ করেছি। পাইপলাইনে কিছু কারিগরি ত্রুটি ছিল, সেগুলো সমাধান করা হয়েছে। পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ।
প্রকল্প পরিচালক পেট্রোলিয়াম ট্রান্সমিশন কো¤পানির প্রকৌশলী মো. আমিনুল হক বলেন, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা গুপ্তখালের পাশে আমাদের পাইপলাইন, ডিপো, রিজার্ভার সব প্রস্তুত করা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ এই পাইপলাইন ২২টি নদী ও খালের নিচ দিয়ে এসেছে। পুরো রুটে পা¤িপং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে মোট ৯টি ও আধুনিক ডিপো দ্বারা সংযুক্ত।
সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের নির্মাণে ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন চট্টগ্রাম থেকে ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত। পরিবেশবান্ধব, ঝুঁকিমুক্ত, পরিবহন ব্যয় ও সময় সাশ্রয়ী ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ২৪২ কিলোমিটার পাইপলাইনে চট্টগ্রাম থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ মেট্টিকটন ডিজেল যাবে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপোতে।
আমিনুল হক আরও বলেন, গত ২২ জুন প্রাথমিক পর্যায়ে ঘণ্টায় ২৬০-২৮০ টন পাঠানো হয়েছে। পদ্মা, মেঘনার পর পাইপলাইনে তেল যায় যমুনার। পাইপলাইনে তেল গেছে কুমিল্লার ডিপোতেও। এর মধ্য দিয়ে অপারেশনাল সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও প্রকল্প হস্তান্তর প্রক্রিয়ার প্রাথমিক কার্যক্রম চলছিল।
পেট্রোলিয়াম ট্রান্সমিশন কো¤পানি পিএলসি (পিটিসিপিএলসি) ও প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা এই জ্বালানি সরবরাহের বিষয়টি তদারকি করেছেন। পতেঙ্গায় স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টা পুরো পাইপলাইন পরিবহণ প্রক্রিয়া ও নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করা হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
সূত্র জানায়, বছরে ৫০ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহের সক্ষমতাসহ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত, সিস্টেম লস কমানো, নৌপথে তেল পরিবহনের বিপুল খরচ সাশ্রয়, পরিবেশ সুরক্ষা, ঝুঁকিমুক্তভাবে দ্রুততম সময়ে তেল পরিবহনের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত আড়াইশ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়।
প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকায় বাস্তবায়ন করা পাইপলাইন প্রকল্পে বছরে আয় হবে ৩২৬ কোটি টাকা। পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে খরচ হবে ৯০ কোটি টাকা। প্রকল্পের অধীনে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত আড়াইশ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়।
এর মধ্যে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা গুপ্তখাল থেকে ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে ২৪১ দশমিক ২৮ কিলোমিটার পাইপলাইন। ভূগর্ভে স্থাপন করা এসব পাইপলাইনের ব্যাস থাকছে ১৬ ইঞ্চি।
এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে ৮ দশমিক ২৯ কিলোমিটার পাইপলাইন। স্ক্যাডা, টেলিকমিউনিকেশন ও লিক ডিটেকশন করতে এই পাইপলাইনের সঙ্গে অপটিক্যাল ফাইবার কেবল লাইন সংযুক্ত রয়েছে। তবে এসব পাইপলাইনের ব্যাস ১৬ ইঞ্চির পরিবর্তে ১০ ইঞ্চি থাকছে।
পতেঙ্গা থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত পাইপলাইন যাচ্ছে ২২টি নদীর তলদেশ ছুঁয়ে। পাইপলাইনজুড়ে থাকছে ৯টি স্টেশন। আর কুমিল্লার বরুড়ায় ২১ হাজার টনের ধারণক্ষমতাস¤পন্ন স্থাপন হচ্ছে নতুন করে একটি ডিপো। যার জন্য ২৮৬ দশমিক ৮৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
২০১৮ সালে অনুমোদিত ২ হাজার ৮৬১ কোটি টাকার প্রকল্পটি করোনা পরিস্থিতির কারণে বিলম্বিত হয়ে চলতি বছরের মার্চে শেষ হয়, যেখানে খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে বিপিসি।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রায় ২ হাজার ৮৬১ কোটি টাকার প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতিতে সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের মার্চে শেষ হয়েছে।