
ব্রাজিল বাড়ির পাশে ডুপ্লেক্স বাড়ি, আছে জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য দুটি জাহাজও। আছে দুটি ট্যাংক লরিও, আছে প্রিমিও মডেলের গাড়িও। এ ছাড়া গ্রামের বাড়িতে একটি একতলা পাকা ভবন আছে। সবই যমুনা অয়েল কোম্পানীর চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী জয়নাল আবেদীন ওরফে টুটুলের।
জয়নালের অঢেল সম্পদের অভিযোগ নিয়ে গত ১৮ অক্টোবর রবিবার দুদকের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেনের নেতৃত্বে একটি এনফোর্সমেন্ট টিম যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লার ডিপো কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনার সময় মিলে জয়নালের এসব সম্পদের পাহাড়।
দুদকের তথ্যমতে, অভিযানের সময় নারায়ণগঞ্জে আলোচিত ছয় তলা ‘ব্রাজিল বাড়ি’, তার পাশেই ডুপ্লেক্স বিলাসবহুল বাড়ি থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে দুদক টিম। এছাড়াও ব্যক্তিগত গাড়িসহ অভিযোগে থাকা অন্যান্য সম্পদের তথ্য পায় টিম। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে পলাতক আছেন জয়নাল– এমন তথ্যই ছিল দুদকের হাতে।
তবে অবাক করা বিষয় হলো নিজ অফিসের নথিপত্র অনুসারে নিয়মিত অফিস করছেন জয়নাল। হাজিরা খাতায় তার ‘সই’ থাকার প্রমাণ মিলেছে। যদিও পরিদর্শনের সময় তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি। হাজিরা খাতায়ও স্বাক্ষর দেখা যায়নি। সহকর্মীদের দাবি, তিনি ছুটিতে আছেন। তবে দুদক টিমকে কোনো আবেদন দেখাতে পারেননি।
দুদকের অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের উপ-পরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানিগুলোর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তেল চুরির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে যমুনা তেল কোম্পানি লিমিটেডের নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লার ডিপো কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
অভিযানে যমুনা তেল কোম্পানি লিমিটেডের গেজার মো. জয়নাল আবেদীনের মালিকানাধীন ‘ব্রাজিল বাড়ি’ নামক স্থাপনা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে মো. জয়নাল আবেদীনের অবৈধ সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্যও সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত রেকর্ডপত্র ও তথ্য পর্যালোচনা করছে দুদক টিম।
অন্যদিকে দুদকের অপর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি জয়নালের ব্রাজিল বাড়ির জমি জয়নালের বাবার কেনা। যার পরিমাণ ৪ শতাংশ। ওই জমিতেই দেড় দশক আগে দুই ইউনিটের ছয়তলা ভবন নির্মাণ করেন জয়নাল। বাড়িটি তৈরিতে দেড় কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে বলে ধারণা। যদিও পরিমাপ করলে প্রকৃত তথ্য বের হয়ে আসবে।
তাছাড়া ব্রাজিল বাড়ির পাশেই জয়নালের নিজের কেনা ৫ শতাংশ জমিতে আরও একটি ডুপ্লেক্স বিলাসবহুল ভবন রয়েছে। ওই বাড়িতে জয়নালের ব্যক্তিগত অফিস ছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দুটি বাড়িতেই ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
ব্রাজিল বাড়ি ও ডুপ্লেক্স বাড়ি ছাড়াও জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য জয়নালের দুটি জাহাজ ও দুটি ট্যাংক-লরি আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রিমিও মডেলের গাড়িও রয়েছে, যা জয়নালের স্ত্রীর নামে নিবন্ধিত। এ ছাড়া জয়নালের গ্রামের বাড়িতে একটি একতলা পাকা ভবন আছে। যেখানে থাকেন জয়নালের চাচা।
স্থানীয়রা জানান, ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের সময়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ছয়তলা বিশিষ্ট ‘ব্রাজিল বাড়ি’ নির্মাণ করে আলোচনায় আসে জয়নাল। তৎকালীন ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত জোয়াও তাবাজারা ডি অলিভেরিয়া জুনিয়র ওই বাড়ি পরিদর্শন করায় বাড়তি উন্মাদনা যোগ হয়েছিল।
এর অনেক আগে থেকেই আলোচিত সেই ব্রাজিল বাড়ির মালিক যমুনা তেল কোম্পানির চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী জয়নাল আবেদীন ওরফে টুটুলের বিরুদ্ধে সরকারি জ্বালানি তেল চুরিসহ দুর্নীতি এবং অবৈধ আয়ে জমি, ফ্ল্যাটসহ অনেক সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ ছিল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সূত্র জানায়, তেল কোম্পানি যমুনার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ডিপোতে দারোয়ানের চাকরি করতেন জয়নালের বাবা মো. রফিক। তার মৃত্যুর পর ক্যান্টিনের কর্মচারী হিসেবে ‘কাজ নাই, বেতন নাই’ ভিত্তিতে চাকরি পান জয়নাল। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ কর্মী হিসেবে তার চাকরি স্থায়ী হয়। অল্প সময়েই তিনি হয়ে যান গেজার (তেল মাপার কাজ)। তেল মাপার মধ্যে আছে হিসাবের বড় ফাঁকি, যা কাজে লাগিয়ে জয়নাল বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
জয়নালের আরও একটি পরিচয় রয়েছে। তিনি এক দশক ধরে যমুনা অয়েল কোম্পানি লেবার ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি। বিগত সরকারের সময় নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী আওয়ামী রাজনৈতিক পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সে কারণে তার বিরুদ্ধে দুদক কিংবা অন্য কোনো সংস্থা আইনি ব্যবস্থা নেয়নি বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।