
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সমুদ্র উপকূলে নতুন করে হাতে নেওয়া ৪৯৮ কোটি ২৯ লাখ টাকার প্রকল্প কাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কাজের শুরুতেই স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সরবরাহকৃত নোনা বালু ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের বাধ্য হচ্ছে ঠিকাদার ও তদারকি সংস্থা পাউবো।
এর আগে ২৯৩ কোটি টাকার বাঁধের কাজেও একই পরিস্থিতি তৈরী করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সমথির্ত স্থানীয় নেতাকরর্মীরা। আর সেই ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই সেই পরিস্থিতি তৈরী করেছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। গত ৫ আগস্টে পট পরিবর্তনের পর বিএনপি নেতাকর্মীদের ১৯টি গ্রুপ উপকুলজুড়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জিম্মি করে কাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এতে ২০২৭ সালের জুন মাসে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত মাত্র ২.৫০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (পিডিএল), আরএফএল, হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স ও জামিল ইকবাল নামের চারটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেলেও স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট জটিলতায় কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
ছনুয়ায় কাজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার অভিযোগ
উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নে ১০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২ হাজার ৮০০ মিটার বাঁধ সংস্কারের কাজ করছে আরএফএল ও পিডিএল। স্থানীয়দের অভিযোগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক চাপ দিয়ে এখানে কাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিএনপির নাম ভাঙানো একাধিক গ্রুপ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ছনুয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের দুই নেতা বালু সরবরাহ ও লেবার কাস্টিংয়ের কাজ করছেন। এছাড়া বিএনপির এক নেতার প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দুই ব্যক্তি একটি মেশিন পরিচালনা করছেন বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ছনুয়া ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক এক নেতা ও আরও পাঁচজন আলাদা আলাদা গ্রুপ তৈরি করে কাজ ভাগ করে নিয়েছেন। ছনুয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক এক নেতার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ থাকলেও তারা এখনো কাজ শুরু করতে পারেননি। পাথর ও বালু লোড-আনলোডের বিষয়টি দুই ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
খানখানাবাদ ও সাধনপুরেও একই চিত্র
খানখানাবাদ ইউনিয়নের কদমরসুলে ১৪২ কোটি টাকার কাজেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স থ্রি পয়েন্ট’-এর কাজ পরিচালনা করছেন স্থানীয় তিন বাসিন্দা। ‘তালুকদার ট্রেডিং’-এর বালু সরবরাহের কাজ করছেন তিন ব্যক্তি।
‘সিনবাদ জেনারেল ট্রেডিং’-এর পক্ষে আছেন এক ব্যক্তি। অভিযোগ রয়েছে, এরা সবাই স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং প্রভাব খাটিয়ে কাজগুলো নিয়েছেন। সাধনপুরে ৪২ কোটি টাকার কাজেও একাধিক গ্রুপের নাম উঠে এসেছে। এখানে ৭৫০ মিটার কাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বালু ও শ্রমিক সরবরাহে যুক্ত আছে আটজন।
নোনা বালু ও নিম্নমানের সামগ্রীর ব্যবহার
প্রকল্প এলাকায় সরেজমিনে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিসি ব্লকে ২.৫ এফএম মানের সিলেটি বালু ব্যবহারের কথা থাকলেও কোথাও কোথাও স্থানীয় বেতাগী বালু ও সাগরের নোনা পানি ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কালাম, রশিদ আহমদ ও নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেল থেকে বলগেটে করে লোনা পানি দিয়ে বালু আনলোড করা হচ্ছে। ব্লকে ব্যবহার করা হচ্ছে ময়লাযুক্ত পাথর।
খানখানাবাদের বাসিন্দা মুবিন, শাহেদ ও রিদুয়ান জানান, এলাকাবাসী নিম্নমানের কাজের প্রতিবাদ করলে উল্টো ভয়ভীতি দেখানো হয়।
নোনা বালু ব্যবহারের অভিযোগে গত ২৭ অক্টোবর খানখানাবাদে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ওমর সানি আকন অভিযান চালিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এর আগে গত ৩ জুলাই অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে দুটি ড্রেজার জব্দ এবং ড্রেজার মাঝিকে কারাদণ্ড দেন তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জসীম উদ্দিন।
ঠিকাদার ও কর্তৃপক্ষের ভাষ্য
কাজে বাধার বিষয়টি স্বীকার করে ছনুয়া প্রকল্পের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট ম্যানেজার মিরাজ বলেন, পাথর ও সিমেন্ট কোম্পানি সরবরাহ করলেও বালু নিয়ে স্থানীয় একটি পক্ষের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। প্রথমদিকে জোরপূর্বক লবনাক্ত বালু আনলোড করা হলেও আমরা তা গ্রহণ করিনি। আমরা নিজেরা বালু আনলোড করতে চাইলে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিডিএল-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাদিকুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় কিছু মানুষ জোরপূর্বক বালু আনলোড করেছিল, যা আমরা গ্রহণ করিনি। এখন কোম্পানি থেকে সিলেটি বালুর বলগেট আনা হয়েছে এবং নলকূপের পানি ব্যবহার করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অনুপম পাল বলেন, ভাইব্রেটর ছাড়া ব্লক তৈরি ও নোনা পানি ব্যবহারের বিষয়ে আমরা সতর্ক রয়েছি। খানখানাবাদে ঠিকাদারকে কাজ করতে দিচ্ছে না একটি গ্রুপ। তারা কাস্টিং করবে বলে একেকজন একেকটা মেশিন নিয়ে বসে আছে। তাদের গ্রুপিংয়ের কারণে কাজের গতি খুবই ধীর।
প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে প্রতিটি দুর্যোগে ক্ষতবিক্ষত বাঁশখালী। ২০১৫ সালে ২৯৩ কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণ করা হলেও অনিয়মের কারণে তা টেকেনি। এবার ৪৯৮ কোটি টাকার প্রকল্পও যদি সিন্ডিকেটের পেটে যায়, তবে বাঁশখালীর লাখো মানুষের জানমালের নিরাপত্তা আবারও হুমকির মুখে পড়বে।











































