মঙ্গলবার- ২১ অক্টোবর, ২০২৫

বিদেশি সাইটে পর্নো ভিডিও দেওয়া সেই দম্পতি গ্রেপ্তার

বিদেশি সাইটে পর্নো ভিডিও দেওয়া সেই দম্পতি গ্রেপ্তার

ন্তর্জাতিক পর্নোগ্রাফি সাইটে কনটেন্ট প্রকাশ করে বাংলাদেশকে বিতর্কের মুখে ফেলে দেওয়া চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার এক দ¤পতিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

রোববার (১৯ অক্টোবর) বৃহত্তর চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। সোমবার (২০ অক্টোবর) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসিম উদ্দিন খান। গ্রেফতার দ¤পতির নাম বৃষ্টি ও আজিম।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, তারা কয়েক বছর ধরে পর্নো ভিডিও তৈরি করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটে আপলোড করছিলেন। যা ছিল লাখ টাকার ব্যবসা। তাদের এসব কনটেন্ট দেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। বিষয়টি নজরে আসার পর তদন্ত শুরু করে সিআইডি।

পুলিশ জানায়, গ্রেফতার আজিমের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বুরুমছড়ায়। তার বিরুদ্ধে আনোয়ারা থানায় মাদকের একটি মামলা রয়েছে। ওই মামলায় একবার তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। আর তার স্ত্রী বৃষ্টির বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার আন্ধারমানিক (খালপাড়) গ্রামে।

দা¤পত্য জীবনে তারা যৌথভাবে পর্নোগ্রাফিক ভিডিও তৈরি করে বিভিন্ন পেইড সাইটে প্রকাশ করতেন। বিষয়টি সাইবার গোয়েন্দাদের নজরে আসার পর তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এরপর বান্দরবানে অবস্থান নিশ্চিত করে সিআইডি তাদের গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে সিআইডি সূত্র জানায়।

সিআইডি জানিয়েছে, চট্টগ্রাম শহর ও আশপাশ থেকেই নিয়মিতভাবে পর্নো ভিডিও আপলোড করেন এই দম্পতি। এরপর সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সব কিছু এতই সংগঠিতভাবে পরিচালিত হয় যে চট্টগ্রামের পুলিশ বা সাইবার ইউনিট এখনও কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

সূত্র জানায়, বৃষ্টি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় প্রাপ্তবয়স্ক ওয়েবসাইটে সক্রিয় পারফর্মার। ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি সেই প্ল্যাটফর্মের গ্লোবাল পারফর্মার র‌্যাংকিংয়ে অবস্থান করছেন অষ্টম স্থানে। বৈশ্বিক পর্নো বাজারে নিজেদের র্ব্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তারা। কিশোর ও তরুণদেরও টানছে এই অন্ধকার জগতে। এমন অন্তত পাঁচজন নতুন কনটেন্ট নির্মাতা শনাক্ত করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রামভিত্তিক।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে ১৯৪ পোশাক কারখানা ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকিতে

তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের ১৭ মে বৃষ্টি প্রথমবারের মতো একটি ভিডিও আপলোড করেন। এরপর মাত্র এক বছরের মধ্যেই তিনি ১১২টির বেশি ভিডিও প্রকাশ করেন এবং তার ভিডিওগুলো প্রায় ২৬৭ মিলিয়নের বেশি বার দেখা হয়েছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার কোনো প্রাপ্তবয়স্ক পারফর্মারের জন্য নজিরবিহীন সাফল্য।

২৮ বছর বয়সী বৃষ্টি নিজেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের এক নম্বর মডেল হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু তার আসল পরিচয় এখন আন্তর্জাতিক পর্নো ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম জনপ্রিয় পারফর্মার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার উপস্থিতি একইভাবে বিস্তৃত।

তার ফেসবুকে প্রায় ৪৯ হাজার ও ইনস্টাগ্রামে ১২ হাজারের বেশি অনুসারী রয়েছে। ইনস্টাগ্রাম বায়োতে তিনি নিজেকে চড়ৎহ ঈৎবধঃড়ৎ / ইধহমষধফবংয’ং ঘড়.১ গড়ফবষ’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন এবং সরাসরি আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটের লিংক দিয়েছেন, যেখান থেকে দর্শকরা সাবস্ক্রাইব করে তার কনটেন্ট দেখতে পারেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৪ সালের ২২ মে তারা একটি যৌথ টেলিগ্রাম চ্যানেল চালু করে, যার সদস্য এখন প্রায় দুই হাজারের বেশি। চ্যানেলটি মূলত তাদের প্রধান প্রচার ও আয়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। এখানে প্রতিবার নতুন ভিডিও প্রকাশের সময় লিংক, স্ক্রিনশট ও আয়ের হিসাব শেয়ার করা হয়।

চ্যানেলটি বৃষ্টির নামে নিবন্ধিত একটি রবি নম্বর ব্যবহার করে খোলা হয়, আর এর প্রধান অ্যাডমিন হিসেবে রয়েছেন আজিম। এই চ্যানেলের পোস্টগুলো শুধু কনটেন্ট প্রচারের জন্য নয়, বরং নতুন তরুণদের প্রলুব্ধ করার হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। একটা ভিডিও থেকে লাখ টাকা ইনকাম এমন দাবিসহ তারা আয়-সংক্রান্ত স্ক্রিনশট নিয়মিত পোস্ট করে যাচ্ছেন।

২৪ মে ২০২৫ তারিখে একটি পোস্টে দেখা যায়, প্রায় দেড় লাখ টাকার সমপরিমাণ অর্থ লেনদেনের ছবি। আরেকটি পোস্টে দাবি করা হয়, মাত্র একটি ভিডিও থেকেই আয় হয়েছে এক লাখ টাকা।

আরও পড়ুন :  ওমান থেকে কফিন বন্দি হয়ে ফিরল আট প্রবাসী

সিআইডি বলছে, বৃষ্টির প্রোফাইল ড্যাশবোর্ডে ২০২৪ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৫ হাজার ৭০৩ ডলার আয়ের তথ্য পাওয়া গেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ২০ লাখ টাকা। যদিও এসব তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করা হয়নি, তবে ধারাবাহিক পোস্ট ও স্ক্রিনশটের মিল দেখে এটি কেবল প্রচারণা নয়, বরং একটি সংগঠিত রেভিনিউ মডেল বলেই মনে হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া তাদের পোস্টে দেখা যায়, নগদ টাকার বান্ডিল, মোটরবাইক, দামি গহনা ও মাদকদ্রব্যের ইঙ্গিতপূর্ণ উপস্থাপন। এই বিলাসিতা তরুণদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করছে। অনেক কিশোর টেলিগ্রামে নিজেদের ভিডিও পাঠিয়ে কাজের আগ্রহ প্রকাশ করছে।

হাতে আসা বার্তাগুলো থেকে জানা যায়, তাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রায়ই কিশোররা নিজেদের নগ্ন ছবি ও ভিডিও পাঠাচ্ছে কাজ করতে চায় বলে। একাধিকবার তারা নতুনদের আহ্বান করেছেন ইনবক্সে যোগাযোগ করতে, দাবি করেছেন রেজিস্ট্রেশন করলে ৫৫ ডলার বোনাস পাওয়া যাবে।

এক কিশোর ৮ জুন টেলিগ্রামে লিখেছে, আমি কাজ করতে চাই, আমাকে গাইড করুন। গোপনে যোগাযোগ করলে সেই পুরুষ জবাব দেন, চিন্তা করবেন না, টাকার কোনো সমস্যা হবে না আমরা সব ব্যবস্থা করে নেব।

চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় গিয়ে সিআইডি কথা বলেছে আজিমের পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে। ওই গ্রামের বাসিন্দা মো. ফারুক বলেছেন, তার পুরো পরিবারই নানা অপরাধে জড়িত। এলাকায় সবাই জানে তারা খারাপ কাজে আছে।

পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্ট আজিমকে মাদক-সংক্রান্ত ১৫১ ধারার একটি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল আনোয়ারা থানায় দায়ের করা একটি সাধারণ ডায়েরির ভিত্তিতে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মুক্তি পান। তারা তিন ভাইয়ের দু‘জনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ডাকাতিসহ মোট আটটি মামলা রয়েছে। এছাড়া তাদের বাবার নামেও অপরাধের রেকর্ড রয়েছে।

আরও পড়ুন :  বাড়ি-গাড়ি, জাহাজ-লরি সবই আছে যমুনা অয়েলের গেজার জয়নালের!

আজিমও তাদের কাজ অস্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, তার বাবা-মা জানে তারা পর্নো ভিডিও বানাই। এটা তাদের পেশা। এটা কোনো অপরাধ নই। আজিমের বাবা জানিয়েছেন, বৃষ্টি একসময় তাদের পরিবারের পুত্রবধূ ছিলেন, কিন্তু আট বছর আগে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তিনি বলেন, সে আমাদের কোনো কথাই শোনে না। আমরা তাকে ত্যাজ্য করেছি।

বাংলাদেশে ২০১২ সালের পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, পর্নো কনটেন্ট তৈরি, সংরক্ষণ বা প্রচার সবই ফৌজদারি অপরাধ। সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদন্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। তবু এই যুগল প্রকাশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।

পুলিশ ও সাইবার ইউনিটের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, তারা বিষয়টি স¤পর্কে অবগত নন বা তারা বিদেশে অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হয়। অথচ অনুসন্ধান বলছে, ভিডিও ধারণ ও স¤পাদনা হচ্ছে চট্টগ্রামেই, স্থানীয় মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ওয়াইফাই সংযোগ ব্যবহার করে।

একজন সাইবার বিশেষজ্ঞ বলেছেন, তারা ভিডিও আপলোডের সময় ভিপিএন ব্যবহার করে, ফলে অবস্থান র্ট্যাক করা কঠিন। কিন্তু কনটেন্টে স্থানীয় উচ্চারণ, স্থাপনা ও বস্তু দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় সবকিছুই বাংলাদেশের ভেতর থেকে হচ্ছে। এখন প্রশ্ন জাগছে, আইন প্রযুক্তি ও নৈতিকতার ফাঁকফোকরে চট্টগ্রামের মতো শহর থেকে তৈরি হওয়া এমন সব কার্যক্রম কবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে আসবে?

সমাজবিদদের মতে, বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে যেভাবে অনলাইনে এই ধরনের কনটেন্ট নির্মাণ ও প্রচারের চর্চা বাড়ছে, তা ভবিষ্যতে বড় ধরনের সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তরুণদের একাংশ ইতিমধ্যেই অনলাইন খ্যাতি ও দ্রুত অর্থের লোভে ঝুঁকিপূর্ণ পথে হাঁটছে।

ঈশান/খম/মম

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page