
আকর্ষনীয় রংয়ের নানা ধরণের মসলায় ভরে গেছে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ ও নগরীর সবকটি হাটবাজারের বিভিন্ন মসলার দোকান। যা দেখে মনে হয় অত্যন্ত সুস্থ-সবল মসলা। ফলে ভোক্তা সাধারণ এসব মসলা কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। কারণ এসব মসলায় মাখানো হচ্ছে বিষাক্ত রং।
বিষয়টি তেমন জানা ছিল না ভোক্তাদের। তবে বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে র্যাব-৭, চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁও ক্যাম্পের কর্মকর্তারা। র্যাবের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) মো. নূরুল আবছার মঙ্গলবার (২০ জুন) এ তথ্য প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, সম্প্রতি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম মহানগরীর বাকলিয়া থানার চাক্তাই এলাকায় অভিযান চালিয়ে মসলায় বিষাক্ত রং মেশানোর কাজে জড়িত ১০ ব্যবসায়ীকে আটক করেছে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভেজাল রং মিশ্রিত প্রায় ৬০০ কেজি লং, এলাচ দানা, হলুদ, মরিচ ও ধনিয়া এবং ১২ কেজি বিষাক্ত রং ও রাসায়নিক পদার্থ জব্দ করা হয়।
আটককৃতরা হলেন- মো. জসিম উদ্দিন (৪০), মো. শরীফ হোসেন (৪০), মো. আলাউদ্দিন (৩৬), মো. জিলানী (২০), মো. সুজন (১৯), মো. সাইদুল (২০), আবদুল কাদের (৩৮), মো. সজল (৪৩), মো. দেলোয়ার হোসেন (৪৮) ও মো. কামরুল হাসান (২৫)।
আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, মসলা আমদানির পর সেগুলো বাছাই করে রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে বিষাক্ত রং মিশিয়ে দেশের ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের আড়তে বিক্রীর জন্য সংরক্ষণ করা হয়। সেখান থেকে নগরীর সবকটি হাটবাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা এসব মসলা কিনে নিয়ে যায়। রং মেশানোর পর এসব মসলা দেখতে খুব সুন্দর ও আকর্ষনীয় দেখায়। ফলে এগুলোর বিক্রয়ও হয় বেশি।
তারা বলেন, বছরের পর বছর ধরে এই পন্থায় মসলার ব্যবসা করে আসছে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। তবে আসন্ন কোরবানির ঈদকে লক্ষ্য করে বিষাক্ত রং মেশানোর কাজ অনেকাংশে বেড়ে গেছে। কারণ রাসায়নিক ও রং মেশানোর পর এসব মসলার ওজনও বেড়ে যায়। এতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়। বিক্রীও হয় বেশি।
আটককৃতদের দেওয়া এই তথ্য থেকে ধারণা করা হচ্ছে-চট্টগ্রামের সবকটি হাটবাজারে বিভিন্ন দোকানে উজ্জল রংয়ের যেসব মসলা দেখা যায় তার সবই বিষাক্ত রং মেশানো। এই তথ্যের পর র্যাব চাক্তাই-খাতুনগঞ্জসহ নগরীর সবকটি হাটবাজারের দোকানের উপর নজরদারি বাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান বলেন, মসলা আমদানির পর সেগুলো বাছাই করে উজ্জলতার জন্য কিছু রং মেশানো হয় এটা ঠিক। তবে এসব রং তো খাবার উপযোগী। যা জিলাপি তৈরীর কাজেও ব্যবহার করা হয়। এই রং তো বিষাক্ত নয়। তার সাথে আর কোন রাসায়নিক মেশানো হয় কি না তা আমার জানা নেই। তাছাড়া ক্রেতারা তো সুন্দর জিনিসই কিনতে চাই। যার কারণে রং মেশানো হয়। আর রং মেশানো মসলার বিক্রয়ও বেশি।
নগরীর বহদ্দারহাট জয়কালি স্টোরের মালিক রতন চন্দ্র দে বলেন, বাজারে যেসব মসলা বিক্রয় হয় তার সবই রং মেশানো। বিশেষ করে জিরা, শাহি জিরা, লং, এলাচ দানা, দারুচিনি, লবঙ্গ, মেথি, মরিচ, হলুদ, ধনিয়াসহ সবকিছুতেই রং মেশানো হয়। যা আমরা চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ থেকে কিনে এনে খুচরা বিক্রয় করি। মসলায় আমরা কোনো রং মেশায় না। আর রং মেশানো উজ্জল রংয়ের মসলার প্রতি মানুষের আকর্ষণও বেশি।
তিনি বলেন, শুধু গোটা মসলায় রং মেশানো হয় তা নয়, হলুদের গুড়া, মরিচের গুড়া, ধনিয়ার গুড়ায়ও অহরহ রং মেশানো হচ্ছে। যা আরও মারাত্্নক। নগরীর বিভিন্ন মিলে মসলায় রং মেশানো হচ্ছে। অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিও রং মেশানো মসলা প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রী করছে। এসব মসলার গুড়া ওজনে ভারি করার জন্য মেশানো হয় নানারকম রাসায়নিক পদার্থও। আর এসব মসলা খেলে নির্ঘাত মানুষের শরীরের ক্ষতি হবে তাতে কোনো ভুল নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের পুষ্টিবিদ ডাক্তার ইকবাল হোসেন বলেন, খাদ্য হিসেবে কোন রাসায়নিক স্বাস্থ্যসম্মত নয়। বরং অধিকাংশ রাসায়নিক শরীরের জন্য মারাত্নক বিপজ্জনক। যেমন খাদ্যে এখন যেভাবে ফরমালিনের ব্যবহার বেড়ে গেছে, এতে ক্যান্সার, জন্ডিসসহ মারাত্নক জটিলতার মধ্যে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। এখন মসলায় কি ধরণের রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে তা আমার জানা নেই। তবে এটাই বলতে পারি, যে ধরণের রং ও রাসায়নিকই হোক না কেন তা অবশ্যই ক্ষতিকারক এবং প্রাণহানীকর। এ বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদফতর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক নাসরিণ আক্তার বলেন, খাতুনগঞ্জে মসলায় রাসায়নিক ও রং মেশানোর বিষয়ে আমরা অবগত হয়েছি। র্যাবও বিষয়টি আমাদের জানিয়েছে। খাতুনগঞ্জে একটি বড় ধরণের অভিযোগ পরিচালনার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। আশা করি শীঘ্রই অভিযানে নামতে পারব আমরা।