
শুরুতেই রং চকচকে পণ্যের মোড়ক আর মনভোলানো বিজ্ঞাপনে সাধারণ মানুষ মনে আস্থা গেড়ে বসেন চট্টগ্রামের ছয় বেকারি। আর সেই ভরসা বা আস্থার জায়গাকে পুঁজি করে প্রতিনিয়ত অস্বাস্থ্যকর ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার বিক্রি করে নিয়মিত ভোক্তা সাধারণের সাথে প্রতারণা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
এগুলো হচ্ছে-ওয়েল ফুড, বনফুল, মধুবন, সিজল, ফ্লেভার্স ও মিষ্টিমেলা। রয়েছে আরো নামকরা বিভিন্ন পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। যাদের বিরুদ্ধে কোনোরকম অভিযান চালানো হয়নি গত সাত মাস ধরে। সর্বশেষ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের আগে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চালায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়। দেন মোটা অংকের জরিমানা।
তাতেও ভেজাল খাদ্য তৈরি থামাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকেরা। বরং খাদ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে জরিমানার খরচ পুষিয়ে নিচ্ছেন তারা। ফলে নির্বিঘ্নে অস্বাস্থ্যকর ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য তৈরী করে বাজারে সরবরাহ করছে নানা কৌশলে। এমন দাবি সচেতন মহলের। সচতেন মহলের মতে, অভিযানে জরিমানা করা হলেও মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো রকম মামলা বা গ্রেফতার না করায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের (ক্যাব) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, লাইসেন্স ছাড়া পণ্য তৈরি, ভেজাল বা মেয়াদোর্ত্তীর্ণ খাদ্যপণ্য, কোমল পানীয় বিক্রি, অনুমোদন ছাড়াই বিএসটিআইয়ের লোগো (মানচিহ্ন) ব্যবহারসহ বিভিন্ন প্রতারণায় ভরপুর প্রতিষ্ঠানগুলোর আমলনামা।
এসব প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি স্বরূপ জরিমানা দেয়া স্বত্ত্বেও হচ্ছে না চারিত্রিক পরিবর্তন। যতবার অভিযান হয়েছে ততবার প্রমাণ মিলেছে ওয়েল ফুড, বনফুল, মধুবন, ফ্লেভার্স, সিজল ও মিষ্টিমেলাসহ বিভিন্ন নামিদামি ব্রান্ডের প্রতারণার তথ্য। সাধারণ মানুষ কাদের উপর দু‘চোখ বুজে আস্থা রাখবে সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে এখন।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগরীর লালখানবাজার এলাকার মেসার্স ফ্লেভার্স সুইটস এন্ড কনফেকশনারী অনুমোদন ছাড়াই পণ্যের প্যাকেটের গায়ে বিএসটিআইর মানচিহ্ন ব্যবহার করায় ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। শুধু তাই নয়, গত বছরের ২৬ আগস্ট প্যাকেটজাত পেস্ট্রি কেক ও প্লেইন কেকে উৎপাদন মেয়াদ উল্লেখ না করায় প্রতিষ্ঠানটিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
অপরদিকে গত বছরের গত ১৯ আগস্ট সিজলের পরিবেশক জাহান ফুডকে মেয়াদোত্তীর্ণ দই-মিষ্টি সংরক্ষণ করায় ১২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে গত ৯ আগস্ট মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ ও দইয়ের মেয়াদ ঘষে তুলে ফেলায় ৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। এর আগে ৩ মার্চ নগরীর আগ্রাবাদের হাজিপাড়া এলাকার সিজলের কারখানায় পরিচালিত অভিযানে সিজলকে এক লাখ টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
এছাড়া গত বছর ২৬ আগস্ট বিএসটিআই-এর সনদ ছাড়া ফার্মেন্টেড মিল্ক উৎপাদন করায় নগরের কোতোয়ালী মোড়স্থ মেসার্স মিষ্টিমেলা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এছাড়া ৩১ আগস্ট নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য তৈরি এবং পচা মিষ্টি সংরক্ষণের দায়ে চট্টগ্রামে অভিজাত মিষ্টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বনফুলকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর আগে ১৯ আগস্ট অননুমোদিত এনার্জি ড্রিঙ্ক, বৈধ আমদানিকারক ছাড়া বিদেশি পণ্য রাখায় বনফুলকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। একই সময়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্যপণ্য প্রস্তুত করায় মধুবনকেও ২ লাখ টাকা জরিমিানা করা হয়।
এছাড়া পণ্যের মান সনদ ছাড়া পাউরুটি, চানাচুর, জ্যাম ও আইসক্রিম উৎপাদন, বিক্রয়, বিতরণ ও বাজারজাতের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ওয়েল ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কো¤পানিকে জরিমানা করে বিএসটিআই। গত বছর ২২ ডিসেম্বর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাফিসা নাজ নীরার নেতৃত্ব ও পুলিশের সহযোগিতায় ঢাকা মহানগরীর শাহজাহানপুর থানা এলাকায় বিএসটিআইয়ের উদ্যোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে এ জরিমানা করা হয়।
অভিযানকালে বিএসটিআই আইন অনুসারে বাধ্যতামূলক পণ্য মান সনদে অন্তর্ভুক্ত না করে ও মোড়কে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি উল্লেখ না করে পণ্য উৎপাদন, বিক্রয়, বিতরণ ও বাজারজাতের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির আউটলেট ম্যানেজারকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে পণ্যগুলো লাইসেন্সে অন্তর্ভুক্তির কার্যক্রম গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয়।
এর আগে একই সালের ১৪ ডিসেম্বর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাত করার অপরাধে ওয়েল ফুড কারখানাকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ভ্রাম্যমান আদালত।
জরিমানার বিষয়ে ওয়েল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, নিখুঁত পণ্য উৎপাদনে আমাদের কোন ঘাটতি থাকে না। আমরা চেষ্টা করি যাতে ভোক্তারা ভালো মানের খাবার পান। তবে অভিযান নিয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজী নন।
সিজলের চেয়ারম্যান লায়ন আলহাজ্ব মোহাম্মদ নুরুল আলম বলেন, আমরা ভোক্তাদের চাহিদা বিবেচনা করে পণ্য তৈরী করে থাকি। যার কারণে সিজলের পণ্যের ভাল চাহিদা রয়েছে চট্টগ্রামে। তবে প্রশাসনের অভিযানে তা মানহীন, ভেজাল বলা হলেও আমাদের কিছুই করার নেই।
ফ্লেভার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলাউদ্দিন আল হাশেম বলেন, আমরা মান ঠিক রেখেই খাদ্য পণ্য তৈরী করি। এতে ভেজাল কিছুই নেই। তবে মেয়াদোত্তীর্ণের বিষয়টিতে পরিবেশকরা কারসাজি করতে পারে। এতে তো আমাদের হাত নেই। এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে অভিযানের বিষয়টি প্রশংসার যোগ্য।
বনফুল এন্ড কো¤পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা কোনরম ভেজাল ও আস্বাস্থ্যকর খাদ্যপণ্য তৈরী করি না। অভিযানে ভেজাল প্রমাণের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা প্রশাসনের ব্যাপার। সরকারি রাজস্ব বাড়ানোর জন্য প্রশাসন এসব করে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য জরুরি হলেও তার চেয়ে বেশি জরুরি নিরাপদ খাদ্য। টেকসই জীবন ও সু-স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। যারা সততার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করে তাদের সব সময় আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে যারা অনৈতিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করবে তাদের প্রতি আমরা জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করছি। ভোক্তাদের স্বার্থে কোন অসাধু ব্যবসায়ীকে ছাড় দেয়া হবে না। অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
বিএসটিআই চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক নুর মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, আমরা ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। সামনেও এটা অব্যাহত থাকবে। তবে লাইসেন্সবিহীন বা নবায়ন না করে পণ্য তৈরি ও বিক্রির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমরা এখন সেদিকেই জোর দিচ্ছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, অনুমোদনহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার বিক্রি করা অন্যায়। আমরা অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। সম্প্রতি বিএসটিআইয়ের সাথেও আমাদের টিম কাজ করছে। ভোক্তাদের সাথে প্রতারণায় জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে প্রতিবছর প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়। এ কারণে প্রতিবছর মারা যায় চার লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এছাড়া ৫ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই খাবার-জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর প্রাণ হারায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু।
চিকিৎসকরা বলছেন, ভেজাল-মিশ্রিত খাবারগুলো আমাদেরকে আক্রান্ত করছে নানান দিক থেকে। কেউই রেহাই পাচ্ছে না। অনিরাপদ খাদ্য শুধু স্বাস্থ্যের ঝুঁকিরই কারণ নয়, বরং দেহে রোগের বাসা বাঁধারও অন্যতম কারণ। ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সার এমন দুই শতাধিক রোগের জন্য দায়ী অনিরাপদ খাদ্য।