
ডেঙ্গু-চিকনগুনিয়া ও জিকা- মশাবাহিত তিন রোগে এবার জটিল পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মধ্যে চিকনগুনিয়ার সংক্রমণের প্রকোপ বেড়েছে হঠাৎ করে। এছাড়া চট্টগ্রামে প্রায় ৩৭০০ ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে এক বছরে। যার ৮০ শতাংশই নগরীর বাসিন্দা।
তম্মধ্যে ডেঙ্গু রোগে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই তরুণ। আর চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীও পাওয়া গেছে চলতি বছর। এ সংক্রান্ত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
রোববার (২১ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের উপস্থিতিতে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
বেসরকারি সংস্থা এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে গত জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে চালানো গবেষণার ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরী করা হয়।
গবেষণা দলে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, রেলওয়ে হাসপাতালের চিকিৎসক আবুল ফয়সাল মোহাম্মদ নুরুদ্দিন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষণার জন্য নির্ধারিত রোগীদের মধ্যে অনেকের চিকুনগুনিয়ার সঙ্গে ডেঙ্গু-জিকা ভাইরাসও শনাক্ত হয়েছে। প্রতি ১০০ জন চিকনগুনিয়া রোগে আক্রান্তের মধ্যে ১ দশমিক ১ শতাংশ ডেঙ্গু এবং শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ জিকা ভাইরাসে আক্রান্তও পাওয়া গেছে। এই সহ-সংক্রমণ এবারের পরিস্থিতিকে জটিল করেছে।
গবেষণাকর্মে নেতৃত্ব দেওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান বলেন, আমরা যেটা পেয়েছি, ২০২৫ সালে অর্থাৎ চলতি বছরে এসে চট্টগ্রামে চিকনগুনিয়ার প্রভাব হঠাৎ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে গেছে। ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এখানে চিকনগুনিয়ার এত প্রকোপ ছিল না।
গত বছর সবমিলিয়ে চট্টগ্রামে মাত্র সাতশ‘র মতো চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া গিয়েছিল। এবার আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৭০০ বা তারও কিছু বেশি। আর শহরে আক্রান্তের হারটা ছিল বেশি, প্রায় ৮০ শতাংশ। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকনগুনিয়াও এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আদনান মান্নান বলেন, চিকনগুনিয়া এখন শুধুমাত্র একটি সাধারণ ও সাময়িক জ্বরের রোগ নয়। এটার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব তৈরি হচ্ছে। এটা মোকাবেলার জন্য আলাদা কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। জনসাধারণকেও সচেতন করতে হবে। শুধুমাত্র ডেঙ্গু মোকাবেলার কৌশল দিয়ে চিকনগুনিয়া রোধ করা যাবে না।
অন্যদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত মোট ১৭৯৭ জন রোগীর ক্লিনিকাল এবং বায়োলজিক্যাল ডেটা নিয়ে গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে তরুণ জনগোষ্ঠী, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এবং আক্রান্তের হার ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ। শিশু-কিশোর আক্রান্তের হার ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। মধ্যবয়সী ও প্রাপ্তবয়স্ক মিলিয়ে ২২ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন।
ক্লিনিক্যাল উপসর্গ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রায় সব রোগীরই জ্বর ছিল। বমিভাব ও বমি, মাথাব্যথা, মাংসপেশি ও চোখের পেছনে ব্যথা, পেটব্যথা এবং ডায়রিয়ার মতো উপসর্গ উল্লেখযোগ্য হারে ছিল।
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের পর বক্তব্যে সিটি মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেন, নগর এলাকায় ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, এটি একটি বড় জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ। মশার প্রজননস্থল, মৌসুমি ও জলবায়ুগত প্রভাব, নগরের অবকাঠামো এবং মানুষের আচরণ এসব বিষয় বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ না করলে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদে সফল হবে না।
গবেষক দলে আরও ছিলেন- চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডা. এম এ সাত্তার, ডা. মারুফুল কাদের, ডা. নুর মোহাম্মদ, ডা. হিরন্ময় দত্ত, ডা. ইশতিয়াক আহমদ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ডা. এ এস এম লুতফুল কবির শিমুল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের ডা. রজত বিশ্বাস, ইউএসটিসির আইএএইচএস এর ডা. আয়েশা আহমেদ, এপোলো ই¤েপরিয়াল হাসপাতালের ডা. মোহাম্মদ আকরাম হোসেন, নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. অরিন্দম সিং পুলক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিয়ারিং বিভাগের ড. মো. মাহবুব হাসান ও মহব্বত হোসেন, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএমএএম জুনায়েদ সিদ্দিকি।
গবেষক দলের নেতৃত্বে থাকা চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, চট্টগ্রামের ১১০০ রোগীর ওপর ভিত্তি করে চিকনগুনিয়া নিয়ে করা গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম নগরীর ৭টি এলাকা এবং সংলগ্ন তিনটি উপজেলা চিকনগুনিয়া সংক্রমণের হট¯পট হয়ে ওঠে। এগুলো হচ্ছে- নগরীর কোতোয়ালী, বাকলিয়া, ডবলমুরিং, আগ্রাবাদ, চকবাজার, হালিশহর ও পাঁচলাইশ এবং সীতাকুন্ড, বোয়ালখালী ও আনোয়ারা উপজেলা। তবে আক্রান্তদের ৮০ শতাংশই নগরীর বাসিন্দা।
তিনি আরও বলেন, চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত শতভাগ রোগী তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী অস্থিসন্ধির ব্যথায় ভুগেছেন। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ রোগী তিন মাসেরও বেশি সময় চিকনগুনিয়ার প্রভাব ভোগ করেছেন। এছাড়া ৪৫ শতাংশ রোগীর শরীর ফোলা ছিল। একেকজন রোগীকে চিকিৎসায় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। তবে সচেতনতার অভাবে পরীক্ষা না করা এবং কিটের স্বল্পতা ও ভুল রোগ নির্ণয়ের কারণে অনেকে চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলেও পরীক্ষায় শনাক্ত হননি।
এ¯েপরিয়া হেলথকেয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান গোলাম বাকী মাসুদ বলেন, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এখন আর শুধু চিকিৎসা সমস্যা নয়, বরং এটি একটি ব্যাপক জনস্বাস্থ্য ও উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ যা গবেষণাভিত্তিক প্রমাণ ছাড়া মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। জিনগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে শনাক্ত করা নতুন মিউটেশনগুলো রোগের বিস্তার ও তীব্রতা বুঝতে এবং ভবিষ্যৎ চিকিৎসা কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গবেষক ও চিকিৎসকরা বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুধু ডেঙ্গুকেন্দ্রিক কর্মসূচির বদলে চিকুনগুনিয়াকে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সমন্বিত রোগ নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা কর্মসূচির আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জসিম উদ্দিন, মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ সাত্তার, হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইবরাহিম চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. একরাম হোসাইন, এসপেরিয়া হেলথ কেয়ার লিমিটেডের ডা. সারোয়ার আলম।










































