
দক্ষিণ এশিয়ায় কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে এবার মা মাছ ছাড়লো বিপুল পরিমাণ ডিম। সেখান থেকে জেলেরা সংগ্রহ করলো ১৪ হাজার ১৬৫ কেজি ডিম। যা গত বছরের তুলনায় সাড়ে ৩ হাজার কেজি বেশি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মনজুরুল কিবরিয়া জানান, সাগরে লঘুচাপের প্রভাবে মৌসুমের অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোতে বজ্রসহ বৃষ্টির পর বৃহ¯পতিবার দিনগত রাত ২টা থেকে হালদা নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়। ফলে নদীর বিভিন্ন অংশে ডিম ছাড়ে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশ প্রজাতির মা মাছ।
এরপর ৩৫০টি নৌকা ও ৪০০টি জাল নিয়ে ৬৫০ জন জেলে হালদা নদীর মদুনাঘাট ছায়ার চর, রামদাস মুন্সিরহাট, আমতুয়া, নাপিতার গোনা, আজিমের ঘাট, মাচুয়া গোনা, কাগতিয়া, আইডিএফ হ্যাচারি, সিপাহী ঘাট, নোয়াহাট, কেরামতালির বাক এবং অঙ্কুরিগোনা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ডিম সংগ্রহে নামেন।
প্রথম দিকে খুবই সামান্য পরিমাণে নমুনা ডিম পাওয়া যায়। পরে শুক্রবার দুপুরের দিকে জোয়ার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিমের পরিমাণ বাড়তে থাকে। শুক্রবার (৩০ মে) সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে ডিম সংগ্রহের কার্যক্রম। এ সময়ে ১৪ হাজার ১৬৫ কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছে।
এসব ডিম ফোটানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন জেলেসহ সংশ্লিষ্টরা। মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নৌ পুলিশ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি যৌথভাবে ডিম সংগ্রহ পর্যবেক্ষণ এবং পরিবেশ মনিটরিংয়ের কাজ করছে। ডিম নিয়ে নদীর তীরজুড়ে উৎসবের আমেজ চলছে।
তিনি আরও জানান, গত ২০২৪ সালে হালদা নদীতে ১ হাজার ৬৬০ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল। এর আগে ২০২৩ সালে পাওয়া গিয়েছিল ১৪ হাজার ৬৬৪ কেজি, ২০২২ ও ২০২১ সালে ছিল এর চেয়েও কম। তবে ২০২০ সালে নদীতে ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল সাড়ে ২৫ হাজার কেজি। যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
চট্টগ্রাম জেলা সিনিয়র সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, কাক্সিক্ষত ডিম সংগ্রহ করতে পেরে ভীষণ আনন্দিত জেলেরা। বর্তমানে ডিম সংগ্রহকারীরা সরকারি ৬টি হ্যাচারি ও মৎস্যজীবীদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৬৮টি মাটির কুয়ায় ডিম ফুটানোর কাজ চলছে।
কনিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, হালদা নদীর হাটহাজারী অংশে স্থাপিত মদুনাঘাট হ্যাচারি, শাহ মাদারী হ্যাচারি ও মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে আহৃত ডিম থেকে রেণু ফোটানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আহরণকারীরা। প্রশিক্ষিত ডিম আহরণকারীদের মধ্যে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) কর্তৃক মাটির কুয়ায় হ্যাচিং পদ্ধতির আধুনিকায়ন প্রযুক্তির মাধ্যমে রেণু ফোটানোর কাজ চলছে। তাছাড়া নদীর দুই পারে স্থাপিত সনাতনী পদ্ধতির মাটির কুয়ায় রেণু ফোটানোর কাজ করছে ডিম আহরণকারীরা।
আইডিএফ কর্মকর্তারা জানান, এবার পরিবেশ মোটামুটি শীতল থাকায় রেণু উৎপাদনের পরিবেশ ভালো। হালদার পোনা হ্যাচারি পোনার চেয়ে দ্রুত বর্ধনশীলও। ডিম সংগ্রহকারীরা হ্যাচারির কুয়া ও স্থানীয়ভাবে মাটির কুয়ায় রেণু ফুটিয়ে বাজারজাতের মাধ্যমে টাকা আয় করেন। নিষিক্ত এসব ডিমের প্রতিকেজি রেণুর মূল্য দেড় লাখ টাকারও বেশি। রেণু বিক্রি ও মাছ চাষের মাধ্যমে পুরো বছর জীবিকা নির্বাহ করেন ডিম সংগ্রহকারীরা।
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ও হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, বছরের এপৃল থেকে জুনের যেকোনো সময়ে হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়ে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, পূর্ণিমা বা অমাবস্যা জো থাকতে হবে। একই সময়ে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে হবে। নদীতে ফেনাসহ পাহাড়ি ঢল নামবে। ঠিক এই সময়ে পূর্ণ জোয়ার শেষে অথবা পূর্ণ ভাটা শেষে পানি যখন স্থির হয়, তখনই কেবল মা মাছ ডিম ছাড়ে।
সে হিসেবে এপৃল থেকে ডিম সংগ্রহের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন হালদা পাড়ের জেলেরা। এর মধ্যে গত ২৭ মে মঙ্গলবার ভোর রাতে বৃষ্টি ও বজ্রপাতের প্রভাবে হালদা নদীতে প্রথম দফায় নমুনা ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা মাছ। তখন নদীর কিছু কিছু স্থানে স্বল্প পরিমাণে নিষিক্ত ডিম পাওয়া যায়।
কিন্তু নদীতে পাহাড়ি ঢল না নামায় পুরোদমে ডিম ছাড়েনি মা মাছ। সেই থেকে জাল আর নৌকা নিয়ে হালদা পাড়ে ডিম ছাড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুণছিলেন ডিম সংগ্রহকারীরা। বিশেষ করে জো চলাকালে তারা রাত-দিন নির্ঘুম ছিলেন। সর্বশেষ বৃহ¯পতিবার দিবাগত রাতে মা মাছ পুরোপুরি ডিম ছাড়ে।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, খাগড়াছড়ির জেলার বাটনাতলী পাহাড় থেকে নেমে সর্পিল ১০৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হালদা নদী মিলেছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে। দেশের একমাত্র জোয়ার-ভাটার রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র এই নদীর সুরক্ষায় সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তার ফল এই মাছের ডিম। যা মাছের চাহিদা পূরণের সাথে দেশের দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হচ্ছে।