
আন্তর্জাতিক পর্ন তারকা হয়ে উঠেছেন চট্টগ্রামের এক নারী। এতে ছানাবড়া পুলিশের চোখ। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওই নারী কীভাবে আন্তর্জাতিক পর্ন তারকা হয়ে উঠেছেন তা নিয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ঢাকাভিত্তিক দ্বিভাষিক অনলাইন পোর্টাল দ্য ডিসেন্ট।
পোর্টালের প্রতিবেদক মারুফ হাসানের এই প্রতিবেদন প্রকাশ হয় শুক্রবার (১৭ অক্টোবর)। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই নারীর যুগল চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। চট্টগ্রাম শহর ও আশপাশ থেকেই নিয়মিতভাবে এই পর্ন ভিডিও আপলোড করা হয়।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আন্তর্জাতিক সার্ভারে চট্টগ্রামের এই দম্পতির ‘পর্ন ভিডিও’ নিয়মিত আপলোড হয়। চট্টগ্রামের ভেতরে থেকেই বৈশ্বিক পর্ন বাজারে নিজেদের ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তারা। দর্শকদের টানছে লক্ষ লক্ষ ডলারের ব্যবসায় এবং কিশোর ও তরুণদেরও টানছে এই অন্ধকার জগতে।
শুধু তাই নয়, দ্য ডিসেন্ট অন্তত পাঁচজন নতুন কনটেন্ট নির্মাতা শনাক্ত করেছে, যাদের বেশিরভাগই চট্টগ্রামভিত্তিক, যদিও তাদের কেউই মুখ দেখাননি। দ্য ডিসেন্ট জানিয়েছে, নারীটি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় প্রাপ্তবয়স্ক ওয়েবসাইটে সক্রিয় পারফর্মার। ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি সেই প্ল্যাটফর্মের গ্লোবাল পারফর্মার র্যাংকিংয়ে অবস্থান করছেন অষ্টম স্থানে।
প্রতিবেদনে তার প্রকৃত নাম প্রকাশ করা হয়নি; তাকে ‘বি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তার সঙ্গে কাজ করা পুরুষ পার্টনার ‘এ’ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দা। তাদের বেশিরভাগ কনটেন্ট ধারণ ও আপলোড করা হয় চট্টগ্রাম শহর কিংবা পার্শ্ববর্তী উপকূলীয় এলাকা থেকে।
দ্য ডিসেন্ট লিখেছে, চট্টগ্রাম শহরের মাঝখান থেকে তৈরি করা ভিডিওগুলো আন্তর্জাতিক সার্ভারে আপলোড হয়। এরপর সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সব কিছু এতই সংগঠিতভাবে পরিচালিত হয় যে চট্টগ্রামের পুলিশ বা সাইবার ইউনিট এখনও কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১৭ মে নারীটি প্রথমবারের মতো একটি ভিডিও আপলোড করেন। এরপর মাত্র এক বছরের মধ্যেই তিনি ১১২টির বেশি ভিডিও প্রকাশ করেন এবং তার ভিডিওগুলো প্রায় ২৬৭ মিলিয়নের বেশি বার দেখা হয়েছে। দ্য ডিসেন্ট বলছে, এটি দক্ষিণ এশিয়ার কোনো প্রাপ্তবয়স্ক পারফর্মারের জন্য নজিরবিহীন সাফল্য।
দ্য ডিসেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৮ বছর বয়সী ওই নারী নিজেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বাংলাদেশের এক নম্বর মডেল’ হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু তার আসল পরিচয় এখন আন্তর্জাতিক পর্ন ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম জনপ্রিয় পারফর্মার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার উপস্থিতি একইভাবে বিস্তৃত। ফেসবুকে প্রায় ৪৯ হাজার ও ইনস্টাগ্রামে ১২ হাজারের বেশি অনুসারী রয়েছে। ইনস্টাগ্রাম বায়োতে তিনি নিজেকে ‘Porn Creator / Bangladesh’s No.1 Model’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন এবং সরাসরি আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটের লিংক দিয়েছেন, যেখান থেকে দর্শকরা সাবস্ক্রাইব করে তার কনটেন্ট দেখতে পারেন।
দ্য ডিসেন্ট অনুসন্ধানে জানায়, ২০২৪ সালের ২২ মে তারা একটি যৌথ টেলিগ্রাম চ্যানেল চালু করে, যার সদস্য এখন প্রায় দুই হাজারের বেশি। চ্যানেলটি মূলত তাদের প্রধান প্রচার ও আয়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। এখানে প্রতিবার নতুন ভিডিও প্রকাশের সময় লিংক, স্ক্রিনশট ও আয়ের হিসাব শেয়ার করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চ্যানেলটি নারীটির নামে নিবন্ধিত একটি রবি নম্বর ব্যবহার করে খোলা হয়, আর এর প্রধান অ্যাডমিন হিসেবে রয়েছেন ‘এ’। দুজনেরই ফোন নম্বরের আংশিক সংখ্যা দ্য ডিসেন্টের হাতে আছে এবং তা যাচাইও করা হয়েছে।
এই চ্যানেলের পোস্টগুলো শুধু কনটেন্ট প্রচারের জন্য নয়, বরং নতুন তরুণদের প্রলুব্ধ করার হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘একটা ভিডিও থেকে লাখ টাকা ইনকাম’—এমন দাবিসহ তারা আয়-সংক্রান্ত স্ক্রিনশট নিয়মিত পোস্ট করে যাচ্ছেন। ২৪ মে ২০২৫ তারিখে একটি পোস্টে দেখা যায়, প্রায় দেড় লাখ টাকার সমপরিমাণ অর্থ লেনদেনের ছবি। আরেকটি পোস্টে দাবি করা হয়, মাত্র একটি ভিডিও থেকেই আয় হয়েছে এক লাখ টাকা।
দ্য ডিসেন্ট বলছে, নারীটির প্রোফাইল ড্যাশবোর্ডে ২০২৪ সালের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৫ হাজার ৭০৩ ডলার আয়ের তথ্য পাওয়া গেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ২০ লাখ টাকা। যদিও এসব তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করা হয়নি, তবে ধারাবাহিক পোস্ট ও স্ক্রিনশটের মিল দেখে এটি কেবল প্রচারণা নয়, বরং একটি সংগঠিত রেভিনিউ মডেল বলেই মনে হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া তাদের পোস্টে দেখা যায়, নগদ টাকার বান্ডিল, মোটরবাইক, দামি গহনা ও মাদকদ্রব্যের ইঙ্গিতপূর্ণ উপস্থাপন। এই বিলাসিতা তরুণদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করছে। দ্য ডিসেন্ট লিখেছে, অনেক কিশোর টেলিগ্রামে নিজেদের ভিডিও পাঠিয়ে কাজের আগ্রহ প্রকাশ করছে।
হাতে আসা বার্তাগুলো থেকে জানা যায়, তাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রায়ই কিশোররা নিজেদের নগ্ন ছবি ও ভিডিও পাঠাচ্ছে ‘কাজ করতে চায়’ বলে। একাধিকবার তারা নতুনদের আহ্বান করেছেন ইনবক্সে যোগাযোগ করতে, দাবি করেছেন ‘রেজিস্ট্রেশন করলে ৫৫ ডলার বোনাস’ পাওয়া যাবে।
এক কিশোর ৮ জুন টেলিগ্রামে লিখেছে, ‘আমি কাজ করতে চাই, আমাকে গাইড করুন।’ এক নারী সাংবাদিক গোপনে যোগাযোগ করলে সেই পুরুষটি জবাব দেন, ‘চিন্তা করবেন না, টাকার কোনো সমস্যা হবে না… আমরা সব ব্যবস্থা করে নেব।”
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় গিয়ে দ্য ডিসেন্ট কথা বলেছে পুরুষটির পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে। ওই গ্রামের বাসিন্দা অটোরিকশা চালক ফারুক বলেছেন, ‘তার পুরো পরিবারই নানা অপরাধে জড়িত। এলাকায় সবাই জানে তারা খারাপ কাজে আছে।’
পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্ট পুরুষটিকে মাদক-সংক্রান্ত ১৫১ ধারারা একটি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল আনোয়ারা থানায় দায়ের করা একটি সাধারণ ডায়েরির ভিত্তিতে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মুক্তি পান। পুরুষটির তিন ভাইয়ের দুজনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ডাকাতিসহ মোট আটটি মামলা রয়েছে। এছাড়া তাদের বাবার নামেও অপরাধের রেকর্ড রয়েছে।
পুরুষ সঙ্গী ‘এ’ অবশ্য সাংবাদিকদের কাছে তাদের কাজ অস্বীকার করেননি। দ্য ডিসেন্ট-কে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা-মা জানে আমরা পর্ন ভিডিও বানাই। এটা আমাদের পেশা। আমি কোনো অপরাধ করি না।’
নারীটির শ্বশুর জানিয়েছেন, মহিলাটি একসময় তাদের পরিবারের পুত্রবধূ ছিলেন, কিন্তু আট বছর আগে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তিনি বলেন, ‘সে আমাদের কোনো কথাই শোনে না। আমরা তাকে ত্যাজ্য করেছি।’
বাংলাদেশে ২০১২ সালের পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, পর্ন কনটেন্ট তৈরি, সংরক্ষণ বা প্রচার সবই ফৌজদারি অপরাধ। সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। তবু এই যুগল প্রকাশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
পুলিশ ও সাইবার ইউনিটের কয়েকজন কর্মকর্তার বরাতে দ্য ডিসেন্ট লিখেছে, তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন বা ‘তারা বিদেশে অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হয়।’ অথচ প্রতিবেদনের অনুসন্ধান বলছে, ভিডিও ধারণ ও সম্পাদনা হচ্ছে চট্টগ্রামেই, স্থানীয় মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ওয়াইফাই সংযোগ ব্যবহার করে।
একজন সাইবার বিশেষজ্ঞ দ্য ডিসেন্ট-কে বলেছেন, ‘তারা ভিডিও আপলোডের সময় ভিপিএন ব্যবহার করে, ফলে অবস্থান ট্র্যাক করা কঠিন। কিন্তু কনটেন্টে স্থানীয় উচ্চারণ, স্থাপনা ও বস্তু দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়—সবকিছুই বাংলাদেশের ভেতর থেকে হচ্ছে।’
পুরুষটি দ্য ডিসেন্টকে জানিয়েছেন, এক ভারতীয় নাগরিকের মাধ্যমে তিনি শিখেছিলেন কিভাবে অনলাইনে অ্যাকাউন্ট খুলে আয় করা যায়। এরপর থেকেই তিনি নতুন নতুন ‘ক্রিয়েটর’ যুক্ত করার কাজ শুরু করেন। দ্য ডিসেন্ট অন্তত পাঁচজন নতুন কনটেন্ট নির্মাতা শনাক্ত করেছে—বেশিরভাগই চট্টগ্রামভিত্তিক, যদিও তাদের কেউই মুখ উন্মুক্ত করেননি।
প্রতিবেদনটি শেষ করা হয়েছে একটি সতর্কবাণী দিয়ে—বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে যেভাবে অনলাইনে এই ধরনের কনটেন্ট নির্মাণ ও প্রচারের চর্চা বাড়ছে, তা ভবিষ্যতে বড় ধরনের সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তরুণদের একাংশ ইতিমধ্যেই অনলাইন খ্যাতি ও দ্রুত অর্থের লোভে ঝুঁকিপূর্ণ পথে হাঁটছে।
আইন, প্রযুক্তি ও নৈতিকতার এই ফাঁকফোকরে অনেকের মনেই এখন প্রশ্ন জাগছে, চট্টগ্রামের মতো শহর থেকে তৈরি হওয়া এমন সব কার্যক্রম কবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে আসবে?