বৃহস্পতিবার- ২৭ নভেম্বর, ২০২৫

পূর্ব রেলে সরঞ্জাম ক্রয়ে জুয়েলের জোচ্চুরি!

পূর্ব রেলে সরঞ্জাম ক্রয়ে জুয়েলের জোচ্চুরি!

# খাতার সাথে স্টকের গড়মিলের এন্তার অভিযোগ
# ভুরি ভুরি ভুয়া ফাইল তৈরীর ভয়ঙ্কর তথ্য ফাঁস
# টাকা নেন গুণে গুণে, বুঝিয়ে দেন জগদীশ চাকমা

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সরঞ্জাম ক্রয়ে নানারকম জোচ্চুরির অভিযোগ উঠেছে আমিনুল ইসলাম জুয়েল নামে এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) দপ্তরের জেনারেল সেকশনে প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) পদে কর্মরত তিনি।

জানা গেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি ভুরি ভুরি ভুয়া ফাইল তৈরী করে সরঞ্জাম ক্রয়ের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। যা খাতায় উল্লেখ থাকলেও স্টকে নেই। স্টক যাচাই করলে কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে না থাকার প্রকৃত চিত্র মিলবে এমন দাবি সংশ্লিষ্টদের।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নানা অনিয়ম ও জোচ্চুরির সরকারি অর্থ দিনশেষে গুণে গুণে নেন আমিনুল ইসলাম জুয়েল। আর এই টাকা বুঝিয়ে দেন ওই দপ্তরের প্রধান সহকারি জগদীশ চাকমা। যার প্রমাণ মিলেছে গত ২০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার।

এদিন দুপুরে অভিযোগের বিষয়ে আলাপ করতে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান সহকারি জগদীশ চাকমা এই প্রতিবেদকের সামনে গুণে গুণে ঘুষের টাকা বুঝিয়ে দেন আমিনুল ইসলাম জুয়েলকে। এতে হতভম্ব হয়ে জুয়েল কিছুই না জানার ভান করার মতো মুঠোফোনে অন্যজনের সাথে কথা বলা শুরু করেন।

পরে ওই টাকা টেবিলের উপর রেখে চলে যান জগদীশ চাকমা। এ ঘটনায় জুয়েল বিচলিত হলেও প্রতিবেদককে না চেনায় পুরোদমে স্বাভাবিক ছিলেন জগদীশ চাকমা। পরে মুঠোফোনে জানতে চাইলে জগদীশ চাকমা বলেন, এগুলো অফিসের টাকা। এগুলো স্যারদের টাকা। এ কথা বলে ব্যস্ততা দেখিয়ে তিনি মুঠোফোনের সংযোগ কেটে দেন।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রাম কারাগার থেকে গোপনে সরানো হল সন্ত্রাসী সাজ্জাদ ও স্ত্রী তামান্নাকে

সংশ্লিষ্টদের মতে, সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের জেনারেল সেকশনের আওতায় কম্পিউটারসহ সকল প্রকার ইলেক্ট্রনিক্স ও আসবাবপত্র ক্রয় করা হয়। কিন্তু এসব সরঞ্জাম ক্রয়ের রিক্যুইজিশন ফাইলের প্রতিটি থেকে ১০% কমিশন হাতিয়ে নেন আমিনুল ইসলাম জুয়েল। আবার সরঞ্জাম রিসিভের ক্ষেত্রেও দেখা যায় বড় ধরণের জোচ্চুরি।

অধিকাংশ কেনাকাটায় সরঞ্জাম ক্রয়ের ভাউচার নিয়েই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও সাপ্লাইয়ার্সদের কাছ থেকে গোপনে ২৫-৩০% কমিয়ে ৭০-৭৫% নগদ টাকা লুটে নেন। আর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে সরঞ্জাম বুঝিয়ে পাওয়ার কাগজ প্রেরণ করেন। যা তদারকির অভাবে কারও বুঝার সুযোগ থাকে না।

তার চেয়েও বড় ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটার নামে ভুরি ভুরি ভুয়া রিক্যুইজিশন ফাইল তৈরী করে পুরো অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা তার জন্য নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। যা তার অধীনে গত এক বছরে সরঞ্জাম কেনাকাটার তথ্যগুলো যাচাই করলে কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে না থাকার রহস্য উম্মোচিত হবে। দৃশ্যমান হবে খাতা আর স্টকের ভয়ঙ্কর গড়মিলের তথ্যচিত্র।

এর আগে পাহাড়তলীতে অবস্থিত রেলওয়ের বিভাগীয় ভুসম্পত্তি দপ্তরে এও হিসেবে কর্মরত অবস্থায় লীজের নামে রেলের জায়গা বেচে খাওয়ার সাথে জড়িত ছিলেন আমিনুল ইসলাম জুয়েল। ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর দৈনিক ঈশান এর অনলাইন ও প্রিন্ট ভার্সনে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। যা তদন্ত করে সত্যতা পাওয়ার পর রেলওয়ে ভুসম্পত্তি দপ্তর থেকে তাকে ওএসডি করা হয়। পরে তাকে পাহাড়তলীতে অবস্থিত সিসিএস দপ্তরের জেনারেল সেকশনে এও পদে পদায়ন করা হয়। সেই থেকে সরঞ্জাম ক্রয়ে নানা জোচ্চুরির মাধ্যমে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠে জুয়েলের।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে রেল কর্মকর্তা সেলিমের অনিয়ম অনুসন্ধানে দুদক

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এওজি আমিনুল ইসলাম জুয়েল বলেন, এখানে কোন কেনাকাটা নেই। কি ধরণের সরঞ্জাম কেনাকাটার রিক্যুইজিশন দিতে হয় আমি তাও জানি না। আমি এসব বুঝি না। আমি এখানে নতুন এসেছি, মাত্র ৬ মাস হয়েছে। পরক্ষণে বলেন, এখানে কম্পিউটার ও ফার্ণিচার কেনাকাটা হয়েছে কিছু। তবে আমার হাত দিয়ে কোন কেনাকাটা হয়নি। আর সরঞ্জাম বুঝে নেন জগদীশ বাবু। আমি লাগলে ফাইলে স্বাক্ষর একটা করি। তবে এসব বিষয়ে ভাল জানেন সিসিএস দপ্তরের এসিওএস শরীফ সাহেব আর সদ্য বদলি হওয়া জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (জেনারেল) আসিফ স্যার। আপনি তাদের সাথে কথা বলুন।

জগদীশ চাকমা আপনাকে কিসের টাকা বুঝিয়ে দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা আমাদের ইমপ্রেষ্টের টাকা। মানে কলম কেনার টাকা। তাহলে সেখান থেকে গাড়িভাড়া সাধলেন কেন- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ভাই সাপ্লাইয়ের কাজ করতে চাইলে নিয়ে আসেন। আমি করে দেব। না, আমি ঠিকাদার হতে চাই না, এমন কথা বলার পর তিনি বলেন, অন্য সাংবাদিকরা তো করতেছে ভাই। কারা কারা করতেছে জানতে চাইলে তিনি কয়েকজনের নামও বলেন।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রানজিট ট্রায়ালে পণ্য গেল ভুটানে

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পূর্ব রেলের সিসিএস দপ্তরের এসিওএস শরীফ উদ্দিন বলেন, জুয়েল খুব খারাপ মানুষ। সরঞ্জাম ক্রয়ে তার জোচ্চুরি আছে। ক্রয় করা সরঞ্জাম রিসিভেও রয়েছে নানা অনিয়ম। জগদীশ বাবু একজন সহজ-সরল মানুষ। তাকে দিয়ে এসব খারাপ কাজ করতে বাধ্য করায় সে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (জেনারেল) প্রকৌশলী আসিফুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে আলাপ করব। দেখি কি হয়।

বর্তমান জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (জেনারেল) প্রকৌশলী এস এম মুহিত বলেন, আমি যোগদান করেছি সবেমাত্র। তাকে মুখ চেনা চিনলেও সার্বিক বিষয়ে আজানা। কেউ আমাকে তার বিষয়ে কোন অভিযোগ দেননি। আর এসব অভিযোগ গুরুতর। বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বেলাল উদ্দিন বলেন, অভিযোগের বিষয়টি আমি জানতাম না। আমি একটু দেখি। প্রয়োজন হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঈশান/খম/মসু

(বি: দ্র : রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের এওজি আমিনুল ইসলাম জুয়েলের নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির বিষয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে দৈনিক ঈশান। দ্বিতীয় প্রতিবেদন পেতে দৈনিক ঈশানের সাথে থাকুন)

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page