বৃহস্পতিবার- ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

প্রধান উপদেষ্টার সামনে দুর্গম ৪৭ দিন

প্রধান উপদেষ্টার সামনে দুর্গম ৪৭ দিন

প্রধান নির্বাচন কমিশনার গত ১১ ডিসেম্বর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সারা দেশে যে আনন্দ এবং উচ্ছ্বাস শুরু হয়েছিল তার আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ১৮ ঘণ্টা। তফসিল ঘোষণার পরদিনই প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিবিদ্ধ হন জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতা ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদি।

শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট সড়কে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি। মোটরসাইকেলে থাকা আততায়ী তাঁকে গুলি করে মোটরসাইকেলে করেই পালিয়ে যায়। মাথায় গুলিবিদ্ধ ওসমান হাদিকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, পরে সেখান থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়।

সোমবার তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়েছে। সেখানে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। হাদির ওপর হামলার এই ঘটনা নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনাকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ইনকিলাব মঞ্চের শরিফ ওসমান হাদি দিয়ে শুরু। দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে দেশিবিদেশি চক্র। তাদের টার্গেটে রয়েছেন আরও অন্তত অর্ধশতাধিক জুলাই যোদ্ধা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মঞ্জিলে পৌঁছাতে ইতোমধ্যে মোটা অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগও করেছে তারা।

এ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পরপরই জাতি উদ্যাপন করে বিজয় দিবস। বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা খোলামেলাভাবে নির্বাচনের আগে পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মুখযোদ্ধা ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর সম্প্রতি যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা শুধু একজন ব্যক্তির ওপর আঘাত নয়- এটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত, আমাদের গণতান্ত্রিক পথচলার ওপর আঘাত।’

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই- পরাজিত শক্তি ফ্যাসিস্ট টেরোরিস্টদের এ অপচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে। ভয় দেখিয়ে, সন্ত্রাস ঘটিয়ে বা রক্ত ঝরিয়ে এ দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না।

আরও পড়ুন :  ভোটের মাঠে আনিসুল, গ্রেফতারের দাবি জুলাইযোদ্ধার

তিনি আরও বলেন, আপনাদের প্রতি আহ্বান জানাই- সংযম বজায় রাখুন। অপপ্রচার বা গুজবে কান দেবেন না। ফ্যাসিস্ট টেরোরিস্টরা, যারা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়, আমরা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের মোকাবিলা করব। তাদের ফাঁদে পা দেব না। পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি এ দেশের পবিত্র মাটিতে আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। এ ভাষণের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে আগামী দুই মাস বাংলাদেশের জন্য এক এক কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।

এ রকম একটা পরিস্থিতিতে সবাই তাকিয়ে আছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দিকে। রাজনৈতিক দলগুলো তাঁর কাছে নিরাপত্তা দাবি করছে। সুশীল সমাজ সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সরকারের সক্ষমতা কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। অনেকে দাবি করছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একাধিক সংস্থা সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে অনেক আগেই বিষয়টি অবগত করলেও ওসমান হাদির নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পরপরই এ ধরনের ঘটনা সাধারণ মানুষকে করেছে আতঙ্কিত। এ অবস্থা থেকে আবার একটি স্বাভাবিক উৎসবমুখর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে দেশকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর দায়িত্বের মেয়াদকালে সবচেয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছেন। নির্বাচনের বাকি আছে মাত্র ৪৭ দিন। এ কটা দিন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময়। বাংলাদেশকে এ কঠিন সময়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস। এ জন্যই এদেশের মানুষ এখনো আশাবাদী। মানুষ বিশ্বাস করে, যোগ্য কান্ডারি নিশ্চয়ই তাঁর কথা রাখবেন। দেশবাসীকে একটি নির্বাচন উৎসবের সুযোগ করে দেবেন।

হাদির ওপর হামলার ঘটনার পর প্রধান উপদেষ্টার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত দায়িত্বশীল এবং সময়োচিত। বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান, রাজনৈতিক দলের প্রতি সংযমের আহ্বান জানান। তিনি এখন সার্বক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি মনিটরিং করছেন। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে হাদির উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। ড. ইউনূস দ্রুত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। ঘটনার পরপরই তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করেন তাহলো প্রধান তিন দলের সঙ্গে বৈঠক।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে রেলওয়ের পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে রহস্যজনক আগুন

ওসমান বিন হাদির ওপর হামলার প্রেক্ষাপটে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের ডেকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষমতাচ্যুত শক্তি নির্বাচন বানচাল করতে চাইছে বলে দলগুলোকে সতর্ক করেছেন তিনি। দলগুলোর নেতারাও প্রধান উপদেষ্টাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ষড়যন্ত্র ঠেকাতে তাঁরা দ্বন্দ্ব ভুলে এক থাকবেন।

এ বৈঠকে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন। ওসমান হাদির ওপর হামলা একটি সতর্কবার্তা হিসেবে নিতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এ হামলা পূর্বপরিকল্পিত ও গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ; এর পেছনে বিরাট শক্তি কাজ করছে। ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনটি না হতে দেওয়া। এ আক্রমণটি খুবই ‘সিম্বলিক’। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে মনে হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। তারা প্রশিক্ষিত শুটার নিয়ে মাঠে নেমেছে।’

সরকারের পাশাপাশি দলগুলোকেও শক্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায়, নির্বাচনের সব আয়োজন ভেস্তে দিতে চায়। এগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তিগুলোর মধ্যে নির্বাচনের আগে এখন যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, তা থেকে সরে আসতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘নিজেদের মধ্যে যেন দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাজনৈতিক বক্তব্য থাকবে, কিন্তু কাউকে শত্রু ভাবা বা আক্রমণ করার সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে। নির্বাচনের সময় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তবে মাথায় রাখতে হবে-এটি যেন একটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে নিয়ন্ত্রণে থাকে।’

আরও পড়ুন :  স্কুল জীবনে ভুলের কথা ভুলতে পারছে না ঐশী, চেয়েছেন ক্ষমাও

প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে তিনটি বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে : প্রথমত, নির্বাচন বানচালের জন্য একটি মহল সক্রিয়। তারা এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটানোর চেষ্টা করবে। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলো এখন বিভক্ত এ কারণেই নির্বাচন বিরোধী অপশক্তি এ ধরনের কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।

তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনকালীন সময়ে একে অপরের বিরুদ্ধে সমালোচনা যেন সহনীয় মাত্রা অতিক্রম না করে।

হাদির ওপর হামলার ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করেছে তাহলো নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে অনেক কিছু ঘটবে। নির্বাচন বানচালের জন্য এ রকম আরও ঘটনা ঘটানো হতে পারে। সেজন্য শুধু সরকারকে নয় রাজনৈতিক দলগুলোকেও সতর্ক থাকতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণ করলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, অনতিবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কার্যকর এবং দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমরা আশাবাদী এ কারণে যে আমাদের এই দুর্গম যাত্রায় একজন দক্ষ চালক আছেন। তিনি ড. ইউনূস। গত ১৬ মাস তিনি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দেশকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করেছেন।

৮ আগস্ট এক বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেখান থেকে একটি নির্বাচনের আয়োজন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সামনের পথ আরও কঠিন, আরও অনিশ্চিত। আগামী ৪৭ দিন তাই প্রধান উপদেষ্টা তার মেয়াদকালের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময় পার করবেন। সবার চাওয়া একটাই, শেষ পর্যন্ত ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের বন্দরে নোঙর করুক।

ঈশান/মম/বেবি

আরও পড়ুন