
চট্টগ্রামের দুই আসনে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে চরম নাটকীয়তা চলছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-৬ রাউজান আসনে আগের ঘোষিত প্রার্থী পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) মনোনয়নের বিষয়টি নিজেই নিশ্চিত করেছেন গোলাম আকবর খোন্দকার। প্রার্থী ঘোষণার আগে গোলাম আকবর খোন্দকার মনোনয়নপত্র সংগ্রহও করেছিলেন। মনোনয়নের চিঠি পাওয়ার পর তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে বিএনপি প্রথমে গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছিল। তাকে বাদ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দিয়ে শেষমুহূর্তে ওই আসনে মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়েছে আরেক হেভিওয়েট নেতা গোলাম আকবর খোন্দকারকে।
নেতাকর্মীরা জানান, গোলাম আকবর খোন্দকার চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক। একই কমিটিতে তিনি দীর্ঘদিন সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজপথে সক্রিয় থাকায় তিনি বেশ কয়েকবার কারাবরণ করেন।
গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি হওয়া সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই। তাদের বাড়ি রাউজান উপজেলায়। ওই আসন থেকে গিয়াস কাদের আগেও দু‘বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর তিনি দেশে ফেরেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর রাউজান উপজেলায় বিএনপিতে গিয়াস কাদের ও গোলাম আকবরের অনুসারী হিসেবে দুটি ধারা তৈরি হয়। গত একবছরেরও বেশিসময় ধরে তাদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘাতে এক ডজনেরও বেশি হত্যাকান্ড ঘটে। এমনকি গোলাম আকবর রাউজানে গিয়ে হামলার শিকার হয়ে রক্তাক্ত হয়েছিলেন।
গত ৩ নভেম্বর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭টি আসনে দলের প্রার্থী ঘোষণা করেন। সে সময় চট্টগ্রাম-৪ আসনে কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, চট্টগ্রাম-৬ আসনে গিয়াস উদ্দিন কাদের এবং চট্টগ্রাম-১০ আসনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নাম ঘোষণা করা হয়েছিল।
এদিকে গত শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামের আরও দুইটি আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করে বিএনপি। চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুন্ড ও চট্টগ্রাম নগরের আংশিক) আসনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ আসলাম চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম-১০ (পাহাড়তলী-হালিশহর) আসনে প্রয়াত নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমানের ছেলে সাঈদ আল নোমান চূড়ান্ত মনোনয়ন পান।
তবে চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে এখনো একটি আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেনি। এলডিপি সভাপতি অলি আহমদের নিজস্ব আসন হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া আংশিক) আসনটিতে বিএনপির প্রার্থী কে হচ্ছেন, তা নিয়ে কয়েকদিন ধরে জল্পনা-কল্পনা চলছে। অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি জামায়াতের সঙ্গে জোটে দেওয়ায় এ জল্পনা আরও বেড়েছে।
ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন আহমেদকে বিএনপি ওই আসনে মনোনয়ন দিচ্ছে বলে দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, অলি আহমদের রাজনৈতিক অবস্থান বোঝার জন্য বিএনপি এতদিন আসনটিতে প্রার্থী ঘোষণা করেনি। এর মধ্যে অলির দলের সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনি জোট হয়নি। এলডিপি জামায়াতের সঙ্গে জোট করায় এখন বিএনপি তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করে রাতের মধ্যে ঘোষণা করবে, এমন আভাস মিলেছে।
গত ২১ ডিসেম্বর দুপুরে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জসিম উদ্দিন আহমেদের পক্ষে তার আইনজীবী রাশেদ হামিদ মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) সেটি জমা দেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্য প্রার্থী জসিম উদ্দিন আহমেদ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি জেসিকা শিল্পগ্রুপের কর্ণধার।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি একসময় অলি আহমদেরও ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি চন্দনাইশ উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে সেসময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ তাকে সমর্থন দিয়েছিল।
এদিকে বিএনপির মনোনয়নের খবর প্রকাশের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে জসিমের অতীতের কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন বক্তব্য ও ছবি নতুন করে ছড়িয়ে পড়ে। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র সমালোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এসব ছবিতে তাকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা যায়।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের বিতর্কিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জসিম উদ্দিন আহমেদ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন। ওই নির্বাচনের সময় একটি সভায় তাকে বলতে শোনা যায়, এই গাছবাড়িয়া ও চন্দনাইশ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগসহ দলমত নির্বিশেষে আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইনশাআল্ল¬াহ আপনাদের সাথেই থাকব।
এসময় উপস্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জসিম ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে, জসিম ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে-এমন স্লোগান দিলে তাকেও তাতে কণ্ঠ মেলাতে দেখা যায়।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও নগর যুবলীগ নেতা হেলাল উদ্দিন বাবরের সঙ্গে জসিম উদ্দিন আহমেদের ঘনিষ্ঠ স¤পর্ক রয়েছে। এসব নেতার সঙ্গে তার একাধিক ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
সূত্র মতে, আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ এই ব্যবসায়ী জেসিকা গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্রয়ে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন সাবেক দুই পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ ও শহীদুল হকের ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন বলেও জানা গেছে।
এছাড়া জসিম উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। চট্টগ্রামের আলোচিত হৃদয় তরুয়া হত্যা মামলা ও জুলাইযোদ্ধা এমদাদকে গুলির মামলাসহ একাধিক মামলায় তিনি আসামি। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত এক হত্যাচেষ্টা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর আগে ১০ জুলাই পদ্মা ব্যাংকের ঋণখেলাপি মামলায় জসিম উদ্দিন ও তার স্ত্রী তানজিনা সুলতানাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত। আরও আগে গত ৩০ এপ্রিল একই মামলায় আদালত তাদেরকে পাঁচ মাসের কারাদন্ড দিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
স্থানীয় বিএনপি নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যিনি সুবিধাভোগী ছিলেন, তার হাতে ধানের শীষ তুলে দেওয়া দলীয়ভাবে বিব্রতকর এবং এতে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে জসিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথেও আমার ছবি আছে। আমি মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। আমি সকলের দোয়া চাই। তার আজীবন আওয়ামী লীগের পাশে থাকার বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কল কেটে দেন।
চট্টগ্রাম-১৪ আসনে কাকে প্রার্থী করা হচ্ছে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক স¤পাদক মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, সেটা খুব সম্ভবত রাতের মধ্যে ঘোষণা আসবে। প্রার্থী কে সেটা আমি জানি না।
রাউজান আসনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাউজান আসনে দু‘জনকেই মনোনয়নের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। আপাতত উভয়ে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে থাকবেন। প্রত্যাহারের সময় একজনকে চূড়ান্ত করে আরেকজনকে প্রত্যাহার করতে বলা হবে। এতটুকুই জানি। এর মধ্যে কোন পরিবর্তন হয়েছে কি না সেটা বলা যাচ্ছে না।











































