শুক্রবার- ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গৃহিণী থেকে সফল নারী উদ্যোক্তা ফেরদৌস আক্তার

ফেরদৌস আক্তার। ছিলেন একজন গৃহিণী। ২০২০ সালের করোনাকালীন সময়ে স্বামীর অনুপ্রেরণায় মাত্র ১০ কেজি মরিচের গুঁড়া দিয়ে অনলাইনে মসলার ব্যবসা শুরু করেন তিনি। সেখান থেকে তিনি এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য তিনি এখন মডেল।

চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া প্রত্যন্ত অঞ্চল রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের লুৎফুল বারি পারভেজের স্ত্রী এই ফেরদৌস আক্তার। ‘কুক মাসালা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক এখন তিনি। যেখান থেকে সারাদেশে গুঁড়া মসলা, শিমের বিচি, বিন্নি চাল ও আতপ চালের গুঁড়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারীর প্রসিদ্ধ মিষ্টি মরিচের গুঁড়া, হলুদ, ধনিয়া, মেজবানি মসলা, বিরিয়ানি মসলা, মাংসের মসলা, জিরাসহ মসলা সামগ্রীর ব্যবসা করছেন এ নারী উদ্যোক্তা।

ফেরদৌস আক্তার জানান, ২০২০ সালের জুলাই মাসে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্বামীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। দুই সন্তান নিয়ে কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঠিক এই সময়ে ফেসবুক গ্রুপ ‘উই’-এর সন্ধান পেয়ে ব্যবসা শুরু করি। মাত্র ১০ কেজি মরিচ কিনে সব প্রক্রিয়ার ভিডিও আপলোড দেওয়ার পর গ্রুপে ওই দিন ছয়জন মরিচের গুঁড়ার অর্ডার দেন।

প্রতিদিন মরিচ, হলুদ আর মসলার গুঁড়ার অর্ডার বাড়তে থাকে। ওই মাসেই বিক্রি হয় লাখ টাকার। এরপর থেকে ফেরদৌসকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। করোনার অতিমারিতে পাল্টে যায় আমার জীবন। ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে এখন সারাদেশে নিয়মিত ক্রেতা পাঁচ হাজার জনের ওপরে।

আরও পড়ুন :  আমানত থেকে কর্মীদের বেতন দিচ্ছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক!

গত দুই বছরে অনলাইনের মাধ্যমে প্রায় ২০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়। এভাবে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ধীরে ধীরে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজ এলাকাসহ সারাদেশে পরিচিতিও লাভ করি। এখন আমি স্বপ্ন দেখছি, একজন বড় উদ্যোক্তা হওয়ার। সে লক্ষ্যে রাঙ্গুনিয়ায় আধুনিক একটি মসলা কারখানা স্থাপনের নিরন্তর প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম করে যাচ্ছি।

ফেরদৌস আক্তার বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের নাম ‘কুক মাসালা’। চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের গোচরা গ্রাম থেকে আমি ‘উই’-এর (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) উদ্যোক্তা হয়ে কাজ করছি। আমার উদ্যোক্তাজীবন শুরু হয় ২০২০ সালের জুলাই মাসে। আলহামদুলিল্লাহ, অনেক ভালো সাড়া পাচ্ছি। আমার ভাবনা থেকেও অনেক বেশি। আমার প্রতিষ্ঠান কুক মাসালার প্রোডাক্ট দেশের ৬৪টি জেলায় ছড়িয়ে এখন বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছে। ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকার উত্তরা ও মিরপুর থেকে সবচেয়ে বেশি অর্ডার আসে। হাটহাজারীর মিষ্টি মরিচের গুঁড়ার চাহিদা বেশি ক্রেতাদের।

এছাড়া হলুদ, ধনিয়া, মেজবানি মসলা, বিরিয়ানি মসলা, মাংসের মসলা, জিরা, বিন্নি চাল, শিমের বিচি, আতপ চালের গুঁড়ারও ভাল অর্ডার আসে। রাঙ্গুনিয়ায় স্থানীয়ভাবে প্রথম শ্রেণির কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর শাখা না থাকায় চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে হয় বলে জানান ফেরদৌস।

আরও পড়ুন :  চামড়া যাদের শক্ত সেসব মেয়েদের জন্য এই রঙিন জীবন : বর্ষা

পরিবার থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন জানতে চাইলে ফেরদৌস আক্তার বলেন, উদ্যোক্তা জীবনে পরিবার থেকে ভালোই সাড়া পাচ্ছি। পরিবারের সবাই আমাকে সাপোর্ট ও সহযোগিতা করছে। বিশেষ করে আমার স্বামী পারভেজ আমাকে খুব সহযোগিতা করেছে।

উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম ‘উই’ ফেসবুক গ্রুপ এই কাজে বেশ সহযোগিতা করেছে জানিয়ে ফেরদৌস আক্তার বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন পূরণের প্ল্যাটফর্ম উই না থাকলে আমার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন হয়তো জন্মই নিত না। উই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার পর রাজিব আহমেদ স্যারের অনুপ্রেরণায় আমার ভেতর উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন জন্ম নেয়। উইয়ের প্রেসিডেন্ট নাসিমা আকতার নিশা আপু উই প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টি করেছেন’।

ফেরদৌস আক্তার চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গশ্চি মাঝি পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল কলেজে। পলিটেকনিক্যালে পড়াকালীন রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের লুৎফুল বারি পারভেজের সঙ্গে বিয়ের বেড়াজালে আটকে পড়েন ফেরদৌস আক্তার। ফলে থমকে যায় তার শিক্ষাজীবন। তখন থেকেই তাঁর স্বপ্ন জাগে উদ্যোক্তা হওয়ার। বৈবাহিক জীবনে তাদের দুই সন্তান রয়েছে। বর্তমানে স্বামী আর দুই সন্তানকে নিয়ে উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের গোচরা গ্রামে সুখেই দিনতিপাত করছেন তিনি। স্বামী, সংসার, সন্তান সামলিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তিনি এখন সফল একজন নারী উদ্যোক্তা।

আরও পড়ুন :  ধরপাকড় শুরু, পুরুষশূন্য জোবরা গ্রাম

নারী উদ্যোক্তা পরিচয় দিতে কেমন লাগে জানতে চাইলে ফেরদৌস আক্তার বলেন, আমি একজন নারী। এই পরিচয় দিতে একসময় দ্বিধা কাজ করত। কিন্তু এর সঙ্গে উদ্যোক্তা শব্দটি যোগ হয়েছে। আর আজ নারী উদ্যোক্তা পরিচয় দিতে আমার অহংকার এবং গর্ববোধ হয়। কারণ আমি বোঝা থেকে নিজেকে স¤পদে পরিণত করেছি। আমার এই কাজে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছ আমার বড় আপা। আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন অনেকে বাজে কথা বলেছিল। সেসব বাজে কথা এবং ঝামেলা থেকে আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে আমার বড় আপা, যাকে আমি সম্প্রতি হারিয়ে ফেলেছি।

তিনি আরও বলেন, আমার স্বপ্ন রাঙ্গুনিয়ায় ‘কুক মাসালা’ নামে একটা ফ্যাক্টরি স্থাপন করা। যাতে নিজের পাশাপাশি এলাকার মানুষদেরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারলেই মনে হবে আমি সত্যিকারের একজন নারী উদ্যোক্তা।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সোনিয়া সফি এ প্রসঙ্গে বলেন, ফেরদৌস আক্তার একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই ফেরদৌসের মতো উদ্যোগী হতে হবে। ইচ্ছাশক্তি মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায়। তাঁর স্বপ্ন পূরণ হোক, এ প্রত্যাশা করি। একই সঙ্গে ফেরদৌস আক্তারকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে অন্য নারীরাও উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসুক এ আহবান জানাই।

আরও পড়ুন