
দেশের প্রশাসনিক অঙ্গন, চিকিৎসাব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা ভূমি অফিস, যেখানেই দুর্নীতির গন্ধ, সেখানেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নজরদারি। অন্ধকারে লুকানো দুর্নীতির চোরাগলি এখন আর নিরাপদ নয়! এক সময়ের নীরব অভিযোগ, ফিসফাস করে বলা দুর্নীতির গল্প কিংবা লজ্জায় গুমরে থাকা অনিয়মের শিকার-সবই এখন দৃশ্যমান।
কারণ দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট এখন আর কেবল অভিযোগের খাতা ঘেঁটে নয় বরং সরাসরি মাঠে নামে, চিহ্নিত করে অপরাধ, সংগ্রহ করে প্রমাণ এবং আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় দুর্নীতিবাজদের।
দুদক বলছে, দুদকের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এখন আর কাগজে-কলমেই শুধু আটকে নেই। দুদক এখন মাঠে তৎপর। ‘এনফোর্সমেন্ট ইউনিট’ নামক বিশেষ শাখার মাধ্যমে সরাসরি অভিযানও চালানো হচ্ছে। ছদ্মবেশী নয়, প্রকাশ্যেই হচ্ছে এসব অভিযান। সরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এমনকি জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি ও চক্রকে ধরতে দুদকের সাম্প্রতিক তৎপরতা এখন প্রশংসা কুড়াচ্ছে।
দুদকের ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত ছয় মাসে এনফোর্সমেন্ট ইউনিট পরিচালিত অভিযানের একটি চিত্র বলছে, ৪৬৯টি অভিযান পরিচালনা করেছে এই টিম। পরবর্তী সময়ে সরাসরি ১৭টি মামলা এবং ৭৬টি অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৭৮টি করে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।
অভিযানের মাসভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুদকের গত ডিসেম্বরে পরিচালিত অভিযানের সংখ্যা ৪৯টি এবং অনুসন্ধান ১২টি, জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ ৮৭টি অভিযান এবং অনুসন্ধান করছে ৮টি, ফেব্রুয়ারিতে অভিযান ৬২টি এবং অনুসন্ধান ২৮টি, এছাড়া মামলা ৫টি। মার্চে পরিচালিত অভিযানের সংখ্যা ৪১টি এবং অনুসন্ধান ৪টি, এপ্রিল মাসে সর্বোচ্চ ১২০টি অভিযান, ৮টি মামলা এবং ৪টি অনুসন্ধান করা হয়। সদ্য গত হওয়া মে মাসে ১১০টি অভিযান, ৩টি মামলা এবং অনুসন্ধান চলমান ২০টির।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের তথ্যই প্রমাণ করে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট শুধু অভিযোগ গ্রহণে সীমাবদ্ধ না থেকে মাঠপর্যায়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। অন্ধকারে থাকা মামলাও দেখছে আলোর মুখ। দুদক এখন ধারালো এক তরবারি। প্রায় এক দশক আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চোখে ধুলো দিয়ে দায়মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিও নতুন করে দুদকের জালে ধরা পড়েছে।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঢাকার সার্কেল-১ এর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আনোয়ার আলী নিজের দুর্নীতি ঢাকতে অভিনব কৌশল রপ্ত করেছিলেন। যা সম্প্রতি দুদকের চোখে ধরা পড়ে এবং এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।
জানা যায়, ২০০২ সালে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলে এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। দীর্ঘদিন ধরে দুদকে ওই অভিযোগ পড়ে ছিল। ২০১৫ সালে দুদকের পক্ষ থেকে তাকে নোটিশ দিয়ে নথিপত্র চাওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত তার আয়-ব্যয়ের নথি পর্যালোচনা করে দুদক। শেষে কোনো অনিয়ম না পেয়ে অভিযোগটি নিষ্পত্তি করা হয়।
পরবর্তী সময়ে একই অভিযোগে দুদকের উপ-পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা করেন ২০১৯ সালের ৫ মে। এরপর আবার শুরু হয় অনুসন্ধান। মামলাটির অনুসন্ধান করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-সহকারী পরিচালক মো. মিজানুর রহমান। প্রায় ৬ বছর পর দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে মামলা করে। দুদকের তদন্তে এই দম্পতির ৪ কোটি ১ লাখ ৩৬ হাজার ৮৮৭ টাকা মূল্যের আয় বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়।
দুদকের পরিচালিত অভিযানের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এনফোর্সমেন্ট ইউনিট মূলত দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে তদারকি ও অভিযানে নামছে। অভিযানের সময় অনুসন্ধান টিম সরকারি নথি যাচাই, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ভিডিও ও চিত্র ধারণসহ প্রাথমিক তদন্ত কাজও সম্পন্ন করছে। অভিযান চলাকালে অনিয়ম বা দুর্নীতির প্রমাণ মিললেই কমিশনের অনুমোদনসাপেক্ষে কখনো সরাসরি মামলা আবার কখনো অনুসন্ধান শুরু হচ্ছে। আবার অনুসন্ধান থেকে পূর্ণাঙ্গ তথ্য হাতে এলেই দায়ের হচ্ছে মামলাও। যে মামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
দুদক পরিচালিত অভিযানের প্রাপ্ত তথ্য ও মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের অভিযানের প্রধান লক্ষ্য ছিল- বিভিন্ন সরকারি অফিসে দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজ চক্র। এছাড়া হাসপাতালের ওষুধ চুরি, সরকারি টেন্ডার দুর্নীতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও নিয়োগে অনিয়ম, পাসপোর্ট জালিয়াতি, ভূমি অফিস ও রেজিস্ট্রি অফিসে ঘুষ বাণিজ্যের মতো বিষয়গুলো। এছাড়া গত দেড় যুগে যে অভিযোগগুলো অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে বসেছিল, সে মামলাগুলোও দেখছে আলোর মুখ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) তানজির আহম্মেদ বলেন, আমরা এখন অভিযোগ পাওয়ার পর ফিল্ডে যাই, খোঁজ নিই, প্রমাণ সংগ্রহ করি। অভিযানে প্রমাণ মিললে অনুসন্ধান শুরু হয়। বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে দুদকের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও তৎপরতা বেড়েছে। বলা যায় দুদক এখন আর নক-দন্তহীন বাঘ নয়, দুদক এখন ধারালো তরবারি।