শনিবার- ২৩ আগস্ট, ২০২৫

এস আলমের ছায়াসঙ্গী জাহাঙ্গীরের অবাক প্রতারণা!

জাল সনদে ব্যাংক ভিপি-স্কুল সভাপতি, ২০ বছরে চার ব্যাংক থেকে হাতিয়েছেন সাড়ে ৩ কোটি টাকারও বেশি ‘বেতন-ভাতা’

এস আলমের ছায়াসঙ্গী জাহাঙ্গীরের অবাক প্রতারণা!

রেছেন শুধু এসএসসি পাস। বানিয়েছেন এইচএসসি, বিএ (পাস) এবং ‘মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট’ পাস সনদও। এই জাল শিক্ষাগত সনদ দিয়ে ২০ বছর ধরে দেশের শীর্ষ ব্যাংকগুলোতে চাকরি করেছেন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। শুধু তাই নয়, ৫ আগষ্টের পর তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতির পদও দখল করে নেন জাল সনদে।

শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদ প্রমাণিত হওয়ায় বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) প্রতারক জাহাঙ্গীর আলমকে স্কুল সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে মাধ্যমকি ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রাম। এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক থেকে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) পদ থেকেও চাকরিচ্যুত হন জাহাঙ্গীর আলম।

জাল সনদে চাকরি করার অভিযোগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে শোকজ করে। জবাব না দিয়ে অনুপস্থিত থাকায় শেষ পর্যন্ত তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। ২০২৪ সালের এপ্রিলে একই জাল সনদের ভিত্তিতে তিনি পটিয়ার আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তার পদ হারানোর ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

জাহাঙ্গীর আলমের ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু ২০০৩ সালে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ক্যাশ অফিসার হিসেবে। এরপর ২০১৪ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে, ২০১৭-১৮ সালে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসএভিপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আরও পড়ুন :  পানি উন্নয়ন বোর্ডে ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে বিশাল নিয়োগ

সর্বশেষ ২০১৮ সালে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) হন। ব্যাংক খাতের নির্বাহীদের মতে, এই ২০ বছরে তিনি চারটি ব্যাংক থেকে আনুমানিক সাড়ে ৩ কোটি টাকার বেশি বেতন-ভাতা উত্তোলন করেছেন।

তবে চাকরির পাশাপাশি জাহাঙ্গীর মূলত বিতর্কিত শিল্প গ্রুপ এস আলমের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) হিসেবে কাজ করতেন। আকিজ উদ্দিন ওই পদে আসার আগে জাহাঙ্গীর আলম দীর্ঘ সময় ধরে এস আলমের ছায়াসঙ্গী ছিলেন। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সনদ জালের অভিনব কায়দা

জাহাঙ্গীর আলমের দেওয়া সনদ অনুযায়ী তিনি পটিয়ার আব্দুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, বারইয়াহাট কলেজ থেকে এইচএসসি, ওমর গণি এমইএস কলেজ থেকে বিএ (পাস) এবং ইউএসটিসি থেকে ‘মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট’ পাস করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে তিনি পটিয়া সরকারি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হন। একই বছর বারইয়াহাট কলেজ থেকে পাসের সনদটি জাল। পটিয়া কলেজের ট্যাবুলেশন শিট ও বারইয়ারহাট কলেজের কথিত মার্কশিট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুটিই একই দিনের।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রাম বন্দরে দুই কোম্পানির ১৩৭ কোটির জালিয়াতি

১৯৯৬ সালের ১৭ অক্টোবর পটিয়া কলেজ থেকে ফেল করলেও জাহাঙ্গীর আলম মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট কলেজ থেকে ‘পাস’ করেছেন এইচএসসি! অন্যদিকে জাহাঙ্গীর ইউএসটিসি থেকে ‘মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট’ পাস দাবি করলেও ইউএসটিসির একজন শিক্ষক জানান, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ‘মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট’ নামে কোনো কোর্সই নেই।

এস আলমের ওকালতিতে জাহাঙ্গীর

গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর জাহাঙ্গীরকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা গেছে। তিনি সাইফুল আলম মাসুদের পক্ষ হয়ে তার সম্পদ রক্ষায় নেতাদের সঙ্গে মধ্যস্থতার চেষ্টা করে আসছিলেন।

চট্টগ্রামের বোট ক্লাবে মাসচারেক আগে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এস আলমের সাবেক পিএস জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় সেখানে ছিলেন সাতকানিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জামায়াত নেতা জসীম উদ্দিনও।

গত রমজানের শেষদিকে সৌদি আরবের মক্কায়ও জাহাঙ্গীর আলমকে দেখা গিয়েছিল জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে। ওই সময় সিঙ্গাপুর থেকে এসে মক্কায় অবস্থান করছিলেন সাইফুল আলম মাসুদও।

হারালেন স্কুল সভাপতির পদও

চলতি বছরের এপ্রিলে জাহাঙ্গীরকে পটিয়ার আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি হতে হলে কমপক্ষে স্নাতক পাস হতে হয়।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে খাস জমিতে গড়ে উঠা যেন এক টুকরো ‘ইনডিয়া’

জাল সনদ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তার স্থলে দ্বিতীয় মনোনীত ব্যক্তি মুহাম্মদ জাহিদুল হককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদ জানান, অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় জাহাঙ্গীরকে সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

প্রতারণার তদন্ত দাবি

জাল সনদে ২০ বছর ধরে চাকরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ব্যাংকিং খাতে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বড় ধরনের তদন্তের দাবি উঠেছে।

আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের হেড অব পিআরডি জালাল আহমেদ জানান, জাল সনদে চাকরি বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় চাকরিচ্যুতির পর তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা তিনি অবগত নন। তবে ব্যাংক খাতের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে।

পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানুর রহমান জানান, শিক্ষা বোর্ডের চিঠি হাতে পেলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।   -তথ্য সংগ্রহ : চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page