বুধবার- ১২ মার্চ, ২০২৫

কফিনবন্দি হয়ে চট্টগ্রামে ফিরলেন নোমান, গ্রামের বাড়িতে দাফন

কফিনবন্দি হয়ে চট্টগ্রামে ফিরলেন নোমান, গ্রামের বাড়িতে দাফন
print news

মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে যার বজ্রকন্ঠে এক সময় কেপেঁছিল চট্টগ্রামের রাজপথ। সেই শহরে কফিনবন্ধি হয়ে ফিরেছেন বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান। স্মৃতির সেই শহর থেকে শেষ বিদায় নিয়ে চট্টগ্রামের প্রিয় এই নেতাকে দাফন করা হবে গ্রামের বাড়িতে।

শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বাদ জুমা চট্টগ্রাম মহানগরের জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় জামে মসজিদ মাঠে জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ি রাউজান উপজেলার গহিরায় নেয়া হবে। বাদ আছর সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হবে। আবদুল্লাহ আল নোমানের একান্ত সহকারী নুরুল আজিম হিরু এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নোমানের মরদেহ রাখা হবে। এরপর নেওয়া হবে নোমানের প্রতিষ্ঠিত ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে। সেখানে ১০টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ রাখা হবে।

সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির দলীয় কার্যালয় নসিমন ভবন প্রাঙ্গনে নেতাকর্মীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নোমানের মরদেহ রাখা হবে। এরপর মরদেহ নেয়া হবে জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ ময়দানে। সেখানে জুমার নামাজের পর বেলা আড়াইটায় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।

এরপর আবদুল্লাহ আল নোমানের জন্মস্থান রাউজানে নেওয়া হবে। আসরের নামাজের পর রাউজান উপজেলার গহিরা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সর্বশেষ জানাজা শেষে গহিরার পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হবে।

এর আগে বৃহ¯পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৪টায় জাতীয় পতাকায় মোড়ানো বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল নোমানের মরদেহ ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছে। নগরীর আউটার স্টেডিয়ামে মরদেহবাহী হেলিকপ্টার অবতরণ করে। ছেলে সাঈদ আল নোমানসহ পরিবারের সদস্যরাও হেলিকপ্টারে ছিলেন।

মরদেহ আউটার স্টেডিয়াম থেকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মহানগরীর কাজির দেউড়িতে ভিআইপি টাওয়ারের বাসায়। এ সময় আউটার স্টেডিয়াম থেকে ভিআইপি টাওয়ার পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক বিএনপি নেতাকর্মীর সমাগম ঘটে।

এর আগে মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ভোরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজ বাসায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন রাজনীতিবিদ আবদুল্লাহ আল নোমান। তাঁর মৃত্যুর খবরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাহাকার উঠে! আশি ঊর্দ্ধ আবদুল্লাহ আল নোমান মৃত্যুর আগে নানা রোগে ভুগছিলেন। তারপরও তিনি চট্টগ্রামে নিয়মিত বিএনপির সভা-সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। সর্বশেষ গত জানুয়ারির মাঝামাঝিতে চট্টগ্রামে এসে একাধিক সভায় যোগ দেন তিনি। শেষ নিংশ্বাস ত্যাগের দিন মঙ্গলবার বিকেলেও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপি আয়োজিত এক সমাবেশে যোগ দেয়ার কথা ছিল। সেদিন তিনি আসতে পারলেন না। নোমানের মৃত্যুতে সেই সমাবেশ স্থগিত করা হয়েছে।

মঞ্চ আর মাইকের সঙ্গে নোমানের ৬৩ বছরের পথচলার সমাপ্তি
৮১ বছর বয়সের মধ্যে আবদুল্লাহ আল নোমান ৬৩ বছরই কাটিয়েছেন রাজনীতির ময়দানে। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন এই নেতার। ষাটের দশকের শুরুতে ছাত্র সংগঠনে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতির পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকারের গঠিত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে। সেই শুরু সাম্যবাদী রাজনীতির পথচলার।

১৯৬৫ সালে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলন দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আবদুল্লাহ আল নোমান ছাত্র ইউনিয়নের মেননপন্থী হিসেবে পরিচিত চীনপন্থী অংশে যোগ দেন। তিনি সংগঠনটির বৃহত্তর চট্টগ্রামের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক স¤পাদক ছিলেন।

চট্টগ্রামের প্রবীণ সাংবাদিক জাহিদুল করিম কচি জানান, চট্টগ্রামে চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সূচনালগ্নেই এর হাল ধরেছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। চট্টগ্রামে তিনি শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন। শত শত ছাত্রছাত্রীকে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের পতাকাতলে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৯৬৭ সালে আমি যখন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র, নোমান ভাই তখন আমাকে হাতে ধরে নিয়ে যান ছাত্র ইউনিয়নে। উনার হাত ধরেই আমি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিই। উনি আমার রাজনীতির গুরু। শুধু আমি নয়, আমার মতো শত শত ছাত্রকে তিনি রাজনীতির পাঠ দিয়েছেন। উনার সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল প্রবল। সম্মোহনী শক্তি ছিল অসাধারণ, মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতে পারতেন।

কচি আরও বলেন, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসেবে আবদুল্লাহ আল নোমান চট্টগ্রামে আরও একটি ইতিহাস নির্মাণ করেছিলেন। দেশে বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণ হয় ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ে। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে সেই শহিদ মিনার নির্মাণের অন্যতম কারিগর ছিলেন নোমান।

সেসময়কার কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অমল কান্তি নাথ বলেন, ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শহিদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। শিক্ষকদের মধ্যে আমি এবং ছাবেরী সাহেব এর পক্ষে ছিলাম। প্রধান শিক্ষক বিরোধিতা করলেও আমরা অনড় ছিলাম। তৎকালীন ভাসানীপন্থী ন্যাপের নেতা সৈয়দ জালাল সাহেব শহিদ মিনারের জন্য ইট, বালু, সিমেন্ট পাঠিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ আল নোমান ভাই ফলক নিয়ে গিয়েছিলেন। সেসময় পাকিস্তানি শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এটা নির্মাণ করা সহজ কাজ ছিল না। পরবর্তীতে এ শহিদ মিনার বাংলাদেশে স্কুল পর্যায়ে প্রথম শহিদ মিনার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

জ্যেষ্ঠ্য সাংবাদিক মুস্তফা নঈম বলেন, ঊনষত্তরের গণঅভ্যুত্থানে নোমান চট্টগ্রামের একজন সামনের কাতারের সংগঠক ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি শেষ হলে তিনি যোগ দেন শ্রমিক রাজনীতিতে। এর আগেই অবশ্য তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সং¯পর্শে আসেন। নোমানকে পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি করা হয়। পাশাপাশি ভাসানীপন্থী ন্যাপের রাজনীতিতেও সক্রিয় হন। ১৯৭০ সালে তাকে ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক স¤পাদক করা হয়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আবদুল্লাহ আল নোমান বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সত্তরের দশকের শেষদিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জাগদলের সঙ্গে ভাসানী ন্যাপ একীভূত হয়। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে ন্যাপ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান যোগ দেন বিএনপিতে। আমৃত্যু তিনি এ দলের সঙ্গেই ছিলেন। সর্বশেষ তিনি দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। আশি-নব্বইয়ের দশক, এর পরবর্তী আরও অন্তত এক দশক চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনীতি আবর্তিত হয়েছে আবদুল্লাহ আল নোমানকে ঘিরেই। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের অন্যতম রূপকার হিসেবে বলা হয় আবদুল্লাহ আল নোমানকে।

১৯৯১ ও ২০০১ সালে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। দু‘বারই তিনি বিএনপি সরকারের মন্ত্রিসভায় খাদ্য, মৎস্য ও প্রাণিস¤পদ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৮ সাল পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। গ্রেফতার হয়ে কারাগারেও গিয়েছিলেন। ওই সালে তিনি ডবলমুরিং-হালিশহর আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নোমানের ভূমিকা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে দলকে সুসংগঠিত করতে আবদুল্লাহ আল নোমান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সাহসী নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ছিলেন দল অন্তঃপ্রাণ নেতা। তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতীয়তাবাদী দল এক ত্যাগী, সাহসী, সংগ্রামী সজ্জন ও বর্ণাঢ্য রাজনীতিবিদকে হারালো। দেশের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কর্মকান্ডে তার অবদান দেশ, জাতি ও দল চিরদিন মনে রাখবে।্

চট্টগ্রামের উন্নয়নে অনণ্য অবদান নোমানের
চট্টগ্রামের উন্নয়নেও অবদান কম নয় আবদুল্লাহ আল নোমানের। বিশেষ করে কর্ণফুলী নদীর ওপর শাহ আমানত সেতু, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।

চট্টগ্রামের উন্নয়নে আবদুল্লাহ আল নোমানের নিরলস প্রচেষ্টার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন আশির দশকের ছাত্রদল নেতা, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নে আবদুল্লাহ আল নোমানের অবদান চিরস্মরণীয়। তিনি চট্টগ্রামের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে নানা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়। জনগণের কল্যাণে তার নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ চট্টগ্রামের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page