
১৭ বছর আগে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের মেয়ে জীবন নাহার ইতির বিয়ে হয় একই জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার মোহাম্মদ মহসিনের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই ইতির সুখের সংসার। থাকতেন ঢাকার ধানমন্ডির নিজস্ব ফ্ল্যাটে। স্বামীর ছিল ট্রাভেল অ্যাজেন্সির বড় ব্যবসা। একে একে তাদের সংসার আলোকিত করে চার সন্তান। এর মধ্যে দুই সন্তান যমজ। তাদের নিয়ে আনন্দের সীমা ছিল না ইতি ও তার স্বামী মহসিনের।
কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। করোনার সময়ে ঘুরে যায় তাদের জীবনের চাকা। ধীরে ধীরে ঢাকার বাড়ি, গাড়ি, গ্রামের জমি, ব্যাংক-ব্যালেন্স সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান তারা। শুরু হয় ইতির দুঃখের জীবন। বেচে থাকতে কোটিপতি হয়েও বেছে নেন পোশাক শ্রমিকের কাজ। সেই থেকে তিনি এখনো ভাসছেন কষ্টের অথৈ সাগরে। চার সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
রবিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) তার জীবনের গল্প বলতে গিয়ে প্রতিবেদকের সামনে কেঁদে ফেলেন ইতি। তিনি জানান, ২০২০ সালে করোনার সময় তার স্বামী বিদেশে লোক পাঠানোর জন্য টাকা বিনিয়োগ করেন। কিন্তু কিছু লোক তার সঙ্গে প্রতারণা করলে তিনি বড় ধরনের লোকসানে পড়ে যান। সবাইকে তার নিজ থেকে সেই টাকা পরিশোধ করতে হয়। স্বামীর কাছ থেকেই শুনেছেন, তিনি অনেক লোকসানে পড়েছেন। সেই অঙ্ক অন্তত ২০ কোটি টাকার ওপরে।
এ সময় টাকা পরিশোধ করতে গ্রামের বাড়ি, ঢাকার বাড়ি সবকিছু বিক্রি দিতে হয় মহসিনকে। এরপর ২০২১ সালে ঢাকা থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন তারা। কিন্তু গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে ঠাঁই হয়নি। কেননা, সেখানকার সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেনা শোধ করতে হয় তাদের। পরে তারা চলে আসেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর গোমদণ্ডীতে ইতির বোনের বাড়িতে।
ইতি জানান, ২০২১ সালে বোনের বাড়িতে এসে তার স্বামী মহসিন বোনের স্বামীর মুদি দোকানে কাজ শুরু করেন। বসবাসও শুরু করে সেখানে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে তার বোনের স্বামী মুদি দোকানটি ভেঙে একটি ফার্মেসির দোকান দেন। কিন্তু ফার্মেসি নিয়ে মহসিনের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি এন মোহাম্মদ গ্রুপের কারখানায় স্বল্প বেতনে শ্রমিকের চাকরি নেন। ওই বছরের ১৪ অক্টোবর তিনি স্ট্রোক করেন।
চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে জানা যায়, মহসিনের শরীরে ক্যানসার বাসা বেঁধেছে অনেক আগেই। এন মোহাম্মদে চাকরির ১৪ দিনের মাথায় মারা যান মহসিন। স্বামীকে চাঁদপুরের মাটিতে শুইয়ে জীবনের বাকি সময়টুকু সেখানেই থাকতে চেয়েছিলেন ইতি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। ইতির ঠাঁই হয়নি সেখানে। আবার তাকে চলে আসতে হয়েছে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে। এসে যোগ দেন নগরের বায়েজিদ এলাকার ম্যাফ ফুটওয়্যার লিমিটেডে। প্রতিদিন শহর থেকে দূরের বোয়ালখালী উপজেলায় ফিরে যেতে হয় তাকে।
তিনি বলেন, ‘সারা দিন কারখানায় কাজ করলেও মন পড়ে থাকে সন্তানদের কাছে। স্বামীকে এত তাড়াতাড়ি হারাব কখনো ভাবিনি। চার সন্তানের একজন বড় মেয়ে সামনে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। দ্বিতীয় মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। যমজ সন্তানদের একজন ছেলে, একজন মেয়ে। তাদের বর্তমান বয়স পাঁচ বছর।বর্তমানে দুই মেয়ের পড়াশোনার খরচ, চিকিৎসা, বাচ্চাদের খাবার, ঘর ভাড়া, পরিবহন খরচ, বাজারসহ আমার মাসিক খরচ ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু মাস শেষে বেতন পাই ১৬ হাজার টাকা। এর অর্ধেক টাকা ভাড়া ও খাবারে চলে যায়। বর্তমানে ৫ লাখ টাকার বেশি ব্যক্তিগত ঋণ আছে। স্বামীর পাওনাদাররাও ঘিরে ধরেছেন। এ থেকে কবে মুক্তি মিলবে জানি না। আমি এ অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য সরকার ও সমাজের বিত্তবান-হৃদয়বান লোকদের সাহায্য কামনা করছি।