
বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির আলুটিলা গুহা পর্যটকদের কাছে এক রহস্যময় অভিজ্ঞতার নাম। স্থানীয়ভাবে “মাতাই হাকর” নামে পরিচিত এই গুহার অর্থ হলো ‘দেবতার গুহা’। স্থানীয়দের বিশ্বাস ও কিংবদন্তি ঘিরে এটি যেন আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি গুহাটি তার অনন্য গঠন, ভেতরের ঠাণ্ডা পরিবেশ ও অন্ধকারময় রহস্যের কারণে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
গুহার অবস্থান ও গঠন
খাগড়াছড়ি শহর থেকে প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার দূরে আলুটিলা পাহাড়ের পাদদেশে গুহাটি অবস্থিত। পাহাড় কেটে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এই গুহার দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ মিটার এবং প্রস্থ প্রায় ১৫–১৮ ফুট। ভেতরের পথ একেবারেই আঁকাবাঁকা ও সরু। কোথাও হাত-পা ব্যবহার করে এগোতে হয়, কোথাও আবার মাথা নিচু করে চলতে হয়।
পুরো গুহাজুড়ে চুনাপাথরের আস্তরণ, দেয়ালে ঝুলে থাকা পাথরের খণ্ড আর মাটির নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির ধারা ভ্রমণকারীদের কাছে এক ভিন্ন অনুভূতি জাগায়। গুহার ভেতরে প্রবেশ করলে একেবারেই কোনো আলো পাওয়া যায় না। ফলে টর্চলাইট, মোমবাতি বা স্থানীয়ভাবে ভাড়া পাওয়া মশাল ছাড়া এখানে প্রবেশ করা অসম্ভব। ভেতরে বাতাস খুবই ঠাণ্ডা, আর পানির কলকল শব্দ শোনা যায়, যা গুহার রহস্যময়তাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
নামকরণের ইতিহাস
“আলুটিলা” নামটি এসেছে পাহাড়টির আকৃতি থেকে। পাহাড়ের চূড়া দেখতে অনেকটা আলুর মতো গোলাকার, তাই স্থানীয়রা একে আলুটিলা নামে ডাকতে শুরু করে। অন্যদিকে “মাতাই হাকর” বা দেবতার গুহা নামটি এসেছে স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস থেকে। তাদের ধারণা, একসময় এই গুহায় দেবতার বসতি ছিল এবং এখানকার অস্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ দেবতার উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয়।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
আলুটিলা গুহায় প্রবেশ করা মানেই এক রোমাঞ্চকর অভিযানে নামা। গুহার অন্ধকারে মশালের আলোয় কয়েক ধাপ এগোলেই ভেতরের ভিন্নতর জগৎ চোখে পড়ে। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা, ঝরনার কলকল শব্দ আর আঁকাবাঁকা সরু পথ ভ্রমণকারীদের মনে ভয়ের পাশাপাশি এক ধরনের উত্তেজনা জাগায়।
গুহার ভেতরে অনেক জায়গায় নিচু হয়ে হাঁটতে হয়, আবার কোথাও হাত দিয়ে ভর দিয়ে উঠতে হয়। তাই শারীরিকভাবে সক্রিয় ভ্রমণকারীদের জন্য এটি বিশেষ আনন্দদায়ক। যারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন, তাদের কাছে এই অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিন স্মৃতিতে থেকে যায়।
আকর্ষণের কারণ বাংলাদেশে গুহাভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্র খুব বেশি নেই। সেই দিক থেকে আলুটিলা গুহা ভ্রমণকারীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা এনে দেয়। এটি শুধু একটি প্রাকৃতিক বিস্ময় নয়, বরং স্থানীয় সংস্কৃতি, বিশ্বাস এবং রোমাঞ্চের সমন্বয়ে ভ্রমণকারীদের মনে এক অদ্ভুত আবেশ জাগায়।
যেভাবে যাবেন
দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছে সিএনজি চালিত অটোরিকশা বা স্থানীয় চাঁদের গাড়ি (জীপ) ভাড়া করে সহজেই আলুটিলা যাওয়া যায়। শহর থেকে দূরত্ব মাত্র ৭-৮ কিলোমিটার। সময় লাগে ২০ মিনিটের মতো। পথে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়ক আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভ্রমণকে আরও আনন্দময় করে তোলে।
কোথায় থাকবেন
খাগড়াছড়ি শহরে ভ্রমণকারীদের থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। জনপ্রিয় থাকার জায়গার মধ্যে আছে পানখাইয়া রিসোর্ট, আরন্যক রিসোর্টসহ হোটেল ইকো চন্দ্রিমা, হোটেল ঝর্ণা টিলা ও হোটেল জিরো পয়েন্ট ইত্যাদি। রুম ভাড়ার পরিমাণ ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত, নির্ভর করে হোটেলের মান ও সুবিধার উপর।
খরচ কেমন
বাস ভাড়া ছাড়াও খাগড়াছড়ি শহরে খাবার খরচ জনপ্রতি প্রতিদিন প্রায় ২০০–৩০০ টাকা। আলুটিলা গুহায় প্রবেশ টিকিটের মূল্য সাধারণত ৪০ টাকা। স্থানীয় পরিবহন খরচ ধরতে পারেন আরও ৩০০–৫০০ টাকা। অর্থাৎ একদিনের সফরে জনপ্রতি গড়ে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হতে পারে। আর দুই দিনের ভ্রমণে থাকতে পারে ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকার মতো বাজেট।
ভ্রমণ সতর্কতা
আলুটিলা গুহা খাগড়াছড়ির অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। তবে গুহার ভেতর প্রবেশ করতে হলে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি, নাহলে ভ্রমণ আনন্দের পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। নিচে প্রয়োজনীয় সতর্কতাগুলো দেওয়া হলো—
• আলো সঙ্গে নিন: গুহার ভেতর সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকে। তাই টর্চলাইট, মোমবাতি বা স্থানীয়ভাবে ভাড়া পাওয়া মশাল ছাড়া প্রবেশ করা নিরাপদ নয়।
• শক্ত সোলের জুতা পরুন: গুহার ভেতরের মাটি ও পাথর পিচ্ছিল। সঠিক জুতা না পরলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
• গাইড সঙ্গে নিন: প্রথমবার গুহায় প্রবেশকারীদের জন্য স্থানীয় গাইড নেওয়া জরুরি। তারা পথ চিনিয়ে দেয় এবং দুর্ঘটনা এড়াতে সাহায্য করে।
• শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে সতর্ক থাকুন: গুহার সরু ও আঁকাবাঁকা পথ শিশু বা বয়স্কদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তাদের গুহার ভেতরে না নেওয়াই ভালো।
• বর্ষাকালে সাবধানতা অবলম্বন করুন: বর্ষাকালে গুহার ভেতরে পানি জমে থাকে। এতে পথ আরও পিচ্ছিল হয়ে পড়ে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে।
• একসঙ্গে চলুন: গুহায় একা প্রবেশ করা উচিত নয়। সবসময় দলে একসঙ্গে চললে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
• প্রয়োজনীয় জিনিস সুরক্ষিত রাখুন: অন্ধকারে চলার সময় মোবাইল, মানিব্যাগ বা অন্যান্য জিনিস হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই সেগুলো ভালোভাবে সুরক্ষিত রাখুন।
• শারীরিক সক্ষমতা বিবেচনা করুন: গুহায় প্রবেশে অনেক জায়গায় বাঁক নিতে হয়, কখনো হাত-পা ব্যবহার করতে হয়। তাই শারীরিকভাবে দুর্বল বা অসুস্থ ব্যক্তিদের গুহায় প্রবেশ করা ঝুঁকিপূর্ণ।
আশেপাশে ভ্রমণ স্পট
আলুটিলা গুহার আশেপাশে আরও কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যা ভ্রমণকে আরও সমৃদ্ধ করবে। যেমন—
• রিসাং ঝরনা: গুহার কাছেই অবস্থিত মনোমুগ্ধকর ঝরনা।
• অপর্ণা চন্দ্র স্মৃতি স্তূপ: ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
• রামগড়ের পাহাড়ি দৃশ্য: শহর থেকে কিছুটা দূরে হলেও দর্শনীয়।
শেষ কথা
আলুটিলা গুহা শুধু একটি ভ্রমণকেন্দ্র নয়, বরং প্রকৃতির রহস্য ও সৌন্দর্যকে কাছ থেকে অনুভব করার এক অনন্য স্থান। গুহার অন্ধকারে পথ চলতে চলতে হঠাৎ ঝরনার কলকল ধ্বনি কিংবা ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়া ভ্রমণকারীর মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগায়। আর খাগড়াছড়ির পাহাড়ি সৌন্দর্য পুরো যাত্রাকে করে তোলে আরও স্মরণীয়।
যারা নতুন অভিজ্ঞতার খোঁজে ভ্রমণে যেতে চান, তাদের জন্য আলুটিলা গুহা হতে পারে অসাধারণ একটি গন্তব্য। নিরাপদ ভ্রমণ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বাদ এবং রহস্যময় অভিযানের আনন্দ—সবকিছু মিলিয়ে আলুটিলা গুহা ভ্রমণ হবে নিঃসন্দেহে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।