
নিম্নবিত্তের ফল খাওয়া দুরূহ হয়ে গেছে আরও ৫-৬ বছর আগে। তখন সেটা গিয়ে ঠেকেছিল মধ্যবিত্ত পর্যন্ত। এখন সেই মধ্যবিত্তের কপালেও জুটছে না ফল খাওয়া। বলা যায়, কতিপয় উচ্চবিত্তের খাবার হয়ে গেছে এখন এই ফল। ফলে ক্রেতা কমে তলানিতে ঠেকেছে ফল বেচা-কেনা।
শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ফলের পাইকারি আড়ত রেয়াজ উদ্দিন বাজারের ফলমন্ডি ও খুচরা বাজার বহদ্দারহাট, ষোলশহর দুই নম্বর গেট, আগ্রাবাদ, পাহাড়তলি ফলের বাজারের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রামে ফলের বাজারে এখন তেমন কোন বিদেশি ফল নেই। চায়না থেকে আনা কিছু ফল আর দেশি ফলেই চলছে এই ব্যবসা। তবে দেশি ফল বিদেশি ফলের মতো সুমিষ্ট ও মানসম্মত না হওয়ায় ক্রেতাও নেই। তাছাড়া বিদেশি ফলের সংকটে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে দেশি ফলের দাম। এতে মধ্যবিত্ত যারা আগে ফলের ক্রেতা ছিলেন তারা আর ফল কিনছেন না। কতিপয় উচ্চবিত্ত শ্রেণির কিছু মানুষ মাঝেমধ্যে ফল কিনছেন।
ফল ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, ফলের ব্যবসায় ধস নামে করোনা সংক্রমণের সময় থেকে। এ সময় ডলার সংকটে এলসি (ঋণপত্র) খোলার জটিলতায় ফল আমদানি নিরুৎসাহ করেন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী। এরপর থেকে ফলের বাজার অস্থির হতে শুরু করে। এই সময় মাত্র দুই-তিন দিনের ব্যবধানে চট্টগ্রামে দেশি-বিদেশি ফলের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
এ অবস্থায় ওই সময় রমজানে খাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ফলও পায়নি ক্রেতারা। তখন থেকে দেশি ফল বিক্রি করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এরপর শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এতে ডলার সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠে। তখন সব ভোগ্যপণ্যের মতো ফল আমদানিতেও প্রভাব পড়ে। অর্থপাচার, অনিয়ম-দূর্নীতিতে এই সংকট আর কাটেনি।
এরপর বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর অর্থনীতির উপর আরেক দফা ধাক্কা পড়ে। যা সামলাতে বর্তমান ফল আমদানির উপর অতিরিক্ত শুল্ককর আরোপের কথা জানায় এনবিআর। এতে বাজারে ফলের দাম বেড়ে গেছে ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত। যা মধ্যবিত্তের কেনার নাগালের বাইরে চলে যায়। এতে কমে গেছে ফল বেচা-কেনা। ফলে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ফল ব্যবসায়ীদের এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাটের যমুনা ব্যাংক মার্কেটের নিচ তলার খুচরা ফল ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, পাইকারি বাজারে এখন চায়না থেকে আমদানি করা কমলা, কেনু, আপেল, আঙ্গুর, নাশপাতি এবং দেশের পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত আপেল, মাল্টা, আঙুর, কমলা, আনারস, কলা, পেয়ারা ছাড়া আর কোনো ফল নেই। এসব ফল চাহিদার তুলনায় অনেক কম। দোকান প্রায় খালি। ফলে দামও অনেক বেশি।
তিনি বলেন, বাজারে দেশের পাহাড়ে উৎপাদিত আপেল কেজিপ্রতি ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, মাল্টা ৩২০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রয় হচ্ছে ৪২০ টাকায়। আঙ্গুর ৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০০ টাকায়। পেয়ারাও কেজিপ্রতি ১০০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রয় হচ্ছে ১৫০ টাকায়।
এছাড়া চায়না কমলা ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়, কেনু ২৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫০ টাকা, নাশপাতি ৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০০ টাকা, আনার প্রতিকেজি ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ টাকায়, কলা ডজন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। এভাবে ফলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারাও ফল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।
নগরীর চকবাজারের খুচরা ফল ব্যবসায়ী আবুল ফজলও বলেন একই কথা। তিনি বলেন, বাজারে ফল নেই। তাই ফলের দাম প্রায় দুই থেকে তিনগুণ বেড়েছে। ফলে নিম্নবিত্তরা দূরের কথা, মধ্যবিত্তরা পর্যন্ত ফল খেতে পারছেন না।
চট্টগ্রাম ষোলশহর কর্ণফুলী মার্কেটের ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান বলেন, পাইকারিতে প্রত্যেক ফলের কার্টনে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ফলে আমরাও খুচরায় দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ফলের দাম বেড়ে গেছে।
ফলের দাম বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজারের ফলমন্ডির পাইকারি ফলের ব্যবসায়ীরাও। পাইকারি ফল ব্যবসায়ী তসকির আহমেদ বলেন, রমজানকে সামনে রেখে চীন থেকে কিছু ফল আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু ফল খালাসের আগেই এনবিআর থেকে ফল আমদানিতে স¤পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করে। ১০ শতাংশ বৃদ্ধির এ ঘোষণার সঙ্গে বাজারের প্রত্যেকটি ফলের দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়ে গেছে। ফলে আমদানি করা ফল খালাস নিচ্ছে না ব্যবসায়ীরা। এর প্রভাব পড়েছে দেশি ফলের উপরও। যা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা সৈয়দ মুনিরুল হক জানান, বিদেশি ফলের আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণায় আমদানিকারকরা আন্দোলন শুরু করেছেন। ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফলের চালান খালাস করেননি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। এতে বাজারে প্রভাব পড়েছে।
তিনি জানান, প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে রমজান পর্যন্ত দেশে বিদেশি ফলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। এই সময়ে বাজারে আমদানি করা ফল না থাকায় শুধুমাত্র দেশি ফল দিয়ে বাজারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাজারে সব ধরনের ফলের দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়ছে। অন্যদিকে ক্রেতা না থাকায় মার খাচ্ছেন ফল ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রামের বৃহৎ পাইকারি ফলের আড়ত ফলমন্ডি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ফল আমদানিকারক তৌহিদুল আলম বলেন, এর আগে আমদানিকারক ও ফলমন্ডির ব্যবসায়ীরা মানববন্ধন করেছেন। আমদানি ফলের চালান খালাস না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর মধ্যে এনবিআর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে বর্ধিত শুল্ক বাদ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। তাই ব্যবসায়ীরা আন্দোলন শিথিল করেছেন। কিন্তু বাজারে তো ফল ব্যবসা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ফল আমদানির ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে শুল্ককর কমাতে হবে।