
চট্টগ্রামে মহানগরে সরকারি-বেসরকারি ৯৯টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে ৯৬টিরই নিজস্ব কোন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা ইটিপি নেই। অথচ হাসপাতালে তরল বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি (এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট), ডব্লিউটিপি (ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট), এসটিপি (স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) থাকা বাধ্যতামূলক।
ফলে হাসপাতালাগুলো থেকে নগরীর খোলা ডাস্টবিনে ফেলা চিকিৎসা বর্জ্য ছড়াচ্ছে রোগ। এর মধ্যে নগরীর সর্বশেষ চিকিৎসার ভরসাস্থল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালও রয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় হাসপাতালগুলো তরল বর্জ্য ফেলে পরিবেশের মারাত্নক ক্ষতি করছে। রোগমুক্তির প্রতিষ্ঠান হয়ে উল্টো ছড়িয়ে দিচ্ছে রোগ।
রবিবার (২৩ জুলাই) সকালে এ বিষয়ে জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, আমাদের হাসপাতালে ইটিপি নেই। সিটি করপোরেশনকে বর্জ্য দেওয়া হয়, তারা হালিশহরে নিয়ে যায়। আর তরল বর্জ্য সেবা সংস্থা নামে একটি কো¤পানিকে দেওয়া হয়। সব মেডিকেল বর্জ্য ডিসপোজাল করে এই সেবা সংস্থা। আমাদের হাসপাতালে সব মিলিয়ে প্রতিদিন আনুমানিক ৫-৭ টন বর্জ্য তৈরি হয়।
তিনি বলেন, হাসপাতালের জন্য যে সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি), এটা আসলে বিশাল ব্যাপার। এটা হাসপাতাল তৈরি করার সময় না থাকলে পরে করা মুশকিল হয়ে যায়। এ হাসপাতাল তো করা হয়েছে ১৯৯৭ সালে, এ কারণে এটা নাই। ইতোমধ্যে আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে এসটিপির জন্য চিঠি লিখেছি। কিন্তু সেখান থেকে নির্দেশনা পুরোপুরিভাবে না আসলে তো সম্ভব হবে না। সেটার জন্য আমাদের পরিবেশ ছাড়পত্রও নেই। ৫-৭ বছর আগে পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করা হয়েছে। সেটা আমরা এখনও পাইনি।
সূত্র জানায়, চমেক হাসপাতালের বর্জ্য মজুদকরণ কক্ষে চারজন বর্জ্যকর্মী কাজ করেন। তারা প্রতিদিন বিভিন্ন ওয়ার্ডের আয়া ও পরিচ্ছন্নকর্মীদের কাছ থেকে কঠিন ও তরল বর্জ্য সংগ্রহ করে কনটেইনারে ভরেন। বিশেষ করে কাগজ, টিস্যু, প্যাকেট, প্যাথলজিক্যাল নমুনা, ব্যবহৃত রক্তমাখা গজ, ব্যান্ডেজ, মোজা, ন্যাকড়া, রক্ত, দেহরস, সিরামসহ সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন বর্জ্য কনটেইনারে বোঝাই করেন বর্জ্যকর্মীরা।
এ কাজে তারা কোনোরকম সুরক্ষাসামগ্রী যেমন পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক, স্যানিটাইজার, হেলমেট, জুতা ব্যবহার করছেন না। সুরক্ষাসামগ্রী নেই কেন জানতে চাইলে বর্জ্যকর্মী রেজাউল হক বলেন, আমাদের এসব লাগে না। পরলে আরও গরম লাগে। করোনার সময়ও পরিনি। আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, চমেক হাসপাতালের বর্জ্য মজুদকরণ কক্ষের বাইরে একপাশে কিছু বর্জ্য আলাদাভাবে ফেলে রাখা হয়েছে। সেখানে প্লাস্টিক, পলিথিন ব্যাগ, পানির বোতল, কাগজপত্র, স্যালাইন ব্যাগ, ওষুধের প্যাকেটসহ নানারকম বর্জ্য রয়েছে। আবার অন্যপাশে আরও কয়েকটি বস্তা ভর্তি ওষুধের শিশি-বোতল আলাদাভাবে রাখতে দেখা যায়।
এসব এখানে কেন আলাদাভাবে রাখা হয়েছে জানতে চাইলে বর্জ্যকর্মী রেজাউল হক বলেন, এগুলো আমরা আলাদা করে রেখেছি। এসব বাইরে বিক্রি করে কিছু টাকা পাই। দৈনিক চার-পাঁচশ টাকা করে পাই, বেশি না। এ সময় বর্জ্যকর্মী ইমরুল জানান, তিনি এখানে ২০০১ সাল থেকে বর্জ্যকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। প্রতিদিন তার হাতে ২০-৩০টা সুঁই ঢুকে যায়। হাসপাতাল থেকে বর্জ্যের ড্রামে করে সুইও আসে। সুই না আসলে আমাদের জন্য ভালো হতো।
বর্জ্যকর্মী ইমরুল আরও বলেন, আমরা কনটেইনারে সব বর্জ্য লোড করে দিই। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬-৭টায় গাড়ি এসে তিন শতাধিক ড্রামে তরল ময়লা নিয়ে যায়। আর শুকনো ময়লা নিয়ে যায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) গাড়ি। চসিকের গাড়ি প্রতিদিন ৮ ড্রাম ময়লা নিয়ে যায়। ময়লাগুলো তারা আরেফিননগর পাহাড়ে ফেলে দেয়।
ইমরুলের কথার সূত্র ধরে সরেজমিন নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার আরেফিননগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড ঘেঁষে সমতল থেকে ২০০-৩০০ ফুট উচ্চতার কয়েকটি বর্জ্যের পাহাড়। এখানে চসিকের গাড়ি থেকে নগরের সমস্ত ময়লা ফেলা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি বর্জ্যের পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। আর একটিতে দফায় দফায় ফেলা হচ্ছে নগরের সমস্ত ময়লা। এখানেই নগরীর অন্যান্য গৃহস্থালী বর্জ্যের সাথে ফেলে দেওয়া হচ্ছে মেডিকেল বর্জ্য।
শুধু চমেক হাসপাতাল নয়, নগরীর সরকারি-বেসরকারি প্রায় সকল হাসপাতালের তরল ও কঠিন বর্জ্য প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব বর্জ্য রোদে শুকাচ্ছে, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে, মিশে যাচ্ছে পানিতে। নগরের ফয়েজলেক এলাকায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালের (ইউএসটিসি) তরল বর্জ্য পাশের লেকে ফেলা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানটিকে ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ওয়াজেদ চৌধুরী বলেন, ইটিপির বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরের, আমাদের নয়। আমরা দেখব হাসপাতাল-ক্লিনিকের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের জনবল আছে কি না। সবকিছু পরিপূর্ণ আছে কি না। ক্লিনিকের পক্ষ থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেতে অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হয়।
রোগ ছড়াচ্ছে যেভাবে:
সরেজমিন হালিশহরের টিজি কলোনি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বেশ বড় বড় কয়েকটি বর্জ্যের পাহাড়। চতুর্দিকে উৎকট গন্ধ। সেখানে একদল নিম্নআয়ের মানুষ বর্জ্য ঘাঁটছেন। এরাই চিকিৎসা বর্জ্য থেকে প্রথম জটিল কোন রোগে সংক্রমণ হচ্ছেন।
এ সময় কথা হয় বর্জ্য থেকে প্লাস্টিকসহ অন্যান্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করা আনন্দবাজারের বাসিন্দা আমিরের সাথে। তিনি একটু আগে গাড়ি থেকে ফেলে যাওয়া ময়লা সংগ্রহ করে ধরণ অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যাগে ঢোকানোর কাজ করছেন। তাতে দেখা যায়, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধসহ ওষুধের শিশি ও বোতল, স্যালাইনের ব্যাগ ও সিরিঞ্জ।
জানতে চাইলে আমির বলেন, প্রতি কেজি সিরিঞ্জ ৬০ টাকা ও প্রতি কেজি প্লাস্টিকের ওষুধের বোতল ২০ টাকা বিক্রি হয়। আমি প্রতিদিন ২০-২৩ কেজি জিনিসপত্র পাই। তা বিক্রি করে চার-পাঁচশ টাকা হয়। আমির আরও বলেন, সপ্তাহে ১-২ বার মেডিকেলের গাড়ি আসার সাথে সাথে এখানে বেশ কয়েকজন আসে। তারা এগুলো খুঁজে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে।
এ সময় কয়েকজন লোককে দেখা যায় কুড়িয়ে সংগ্রহ করা এসব বর্জ্য পণ্যের বস্তা জমা নিচ্ছেন। পরিচয় জানতে চাইলে তারা জানান, তারা সবাই বর্জ্য ব্যবসায়ী। ইউনুছ নামের এক বর্জ্য ব্যবসায়ী বলেন, মাসে ৫ কেজির মতো মেডিকেলের শুকনো বর্জ্য পাওয়া যায়। আগে বেশি পাওয়া যেত। আমরা এখান থেকে কিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করে দিই। আবার অনেক ব্যবসায়ী এখানে এসেও কিনে নিয়ে যায়।
এভাবে প্রতিদিন গাড়ি থেকে ফেলা বর্জ্য ঘাটছেন কিছু মানুষ। এদের মধ্যে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত আছেন। ৬০-৮০ জন বর্জ্য থেকে প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন বস্তু সংগ্রহ করছেন। এদের কারও কাছে নেই সুরক্ষাসামগ্রী। সাথে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে একদল গরু ও হাঁস মুরগি। ময়লার স্তুপে উড়ছে শতাধিক পাখি। তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাচ্ছে পঁচা খাবার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, তরল বর্জ্য ফেলায় পরিবেশ মারাত্নকভাবে দূষিত হচ্ছে। ফলে প্রায়ই মারাত্নক রোগবালাই হচ্ছে। ময়লার পাহাড় থেকে বাতাসের মাধ্যমে রোগ ছড়াচ্ছে। আর বৃষ্টির সময় ধুয়ে নগরে ছড়িয়ে পড়ছে, নদীতে যাচ্ছে। আবার সেই নদী থেকে আমরা পানি ব্যবহার করছি। এ বিষয়টা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের একটা জোরালো মুভমেন্ট দরকার। তারা যদি এটার বিরুদ্ধে অ্যাকশন না নেয়, তাহলে তো আমাদের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বিধিমালায় যা আছে :
পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ এবং ২০২৩ অনুযায়ী হাসপাতাল লাল শ্রেণিভুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং এ কারণে এতে পরিবেশগত প্রভাব যাচাইসহ নিজস্ব বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) থাকা বাধ্যতামূলক। এটি স্থাপন না করলে পরিবেশ ছাড়পত্র না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। লাল শ্রেণিভুক্ত প্রতিষ্ঠান স¤পর্কে বলা হয়েছে, এগুলো পরিবেশ বা মানবস্বাস্থ্যের ওপর তীব্র প্রভাব ফেলে।
আবার চিকিৎসাবর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা ২০০৮-এ বলা হয়েছে, চিকিৎসাবর্জ্যের সাথে অন্যান্য বর্জ্য মেশানো যাবে না। বর্জ্যকর্মীদের নিরাপত্তামূলক পোশাক ও অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী দিতে হবে। চিকিৎসাবর্জ্য আবার ব্যবহার রোধে রাবার বা প্লাস্টিক নল ও বিভিন্ন ব্যাগ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলতে হবে। চিকিৎসাবর্জ্য ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন ২০১৫-১৬ অনুযায়ী, পুনঃব্যবহার রোধ করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত সুঁই ব্যবহারের পরপরই কেটে বা গলিয়ে দিতে হয়। নিডল ডেস্ট্রয়ারে এসব ধ্বংস করে দিতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক চালানোর জন্য ছাড়পত্র নিতে হলে ইটিপি স্থাপনসহ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু চমেক হাসপাতালসহ নগরীর সরকারি হাসপাতালগুলোর একটিরও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। স্থাপন করা হয়নি ইটিপি। কিছু বেসরকারি হাসপাতালের আগে নেওয়া পরিবেশ ছাড়পত্র থাকলেও এখন আর নবায়ন করার সুযোগ হচ্ছে না। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর মধ্যে ২-৩টি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ইটিপি ও পরিবেশের ছাড়পত্র।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, বেশ কয়েকবার হাসপাতালগুলোকে নোটিশ করা হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের ড্রয়িং ডিজাইন আমাদের এখানে সাবমিট করেছে। অনুমোদনও হয়েছে। অনেকে কনস্ট্রাকশনের কাজ করছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। যে সব হাসপাতাল ইটিপি ডিজাইন সাবমিট করবে না, তাদের পরিবেশ ছাড়পত্র আমরা নবায়ন করছি না। চমেক হাসপাতালের পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। আমরা তাদের বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছি। তারা ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে।