সোমবার- ৩০ জুন, ২০২৫

পলাতক হাছান মাহমুদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা!

পলাতক হাছান মাহমুদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা!

# পতনের আগের রাতেই পালায় স্ত্রী-সন্তানরা
# দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইউরোপ
# একটুও কমেনি গলার উচুস্বর

দেশ ছেড়ে পালানোর ১০ মাস পর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রী নূরান ফাতেমার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা এলো আদালত থেকে। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়া, জার্মান, লন্ডন ও বেলজিয়ামসহ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। এমনকি সেখানে দলীয় কর্মসূচিতে উচুস্বরে নানা উস্কানিমূলক বিবৃতিও দিচ্ছেন।

মঙ্গলবার (২৪ জুন) দুপুরে এ তথ্য জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সহকারী পরিচালক আল-আমিন। তিনি জানান, চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং তার স্ত্রী নূরান ফাতেমার বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা মামলায় দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে দুটি আবেদন করা হয় গত সোমবার (২৩ জুন) বিকেলে।

পরে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিব আবেদন মঞ্জুর করে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। একইসঙ্গে অবৈধভাবে স¤পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে হাছান মাহমুদের নয়টি ব্যাংক হিসাব ও একটি গাড়ি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

তার স্ত্রীর নূরান ফাতেমারও ১২টি ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে গত ১৬ জানুয়ারি সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের ৭৭টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছিলেন আদালত।

দুদকের আবেদনে বলা হয়, মন্ত্রী ও এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে হাছান মাহমুদ অবৈধভাবে এক কোটি ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৩১৮ টাকার স¤পদের মালিকানা অর্জন করেন। তার নিজ, যৌথ ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে ৯টি ব্যাংক হিসাবে ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য মিলেছে। এই অর্থ পাচারের অভিযোগে গত ৬ এপৃল দুদক মামলা করে। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন।

অন্যদিকে স্বামী হাছান মাহমুদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ত্রী নূরান ফাতেমা ৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা মূল্যের স¤পদের মালিকানা অর্জন করেন। তার নিজ, যৌথ ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত ৫৬টি ব্যাংক হিসাবে ৬৮৩ কোটি ১৫ লাখ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য মিলেছে। গত ৬ এপৃল দুদক তার বিরুদ্ধেও মামলা করেছে। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার বিদেশ গমন ঠেকানো দরকার।

১০ মাস আগে পালিয়েছেন হাছান মাহমুদ
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ২৫ দিন পর নিরাপদে দেশ ছেড়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এর আগে ৬ আগস্ট বিকেলে হাছান মাহমুদকে ঢাকা বিমানবন্দরে আটক করা হয় বলে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র গণমাধ্যমকে জানায়।

এরপর থেকে তিনি সেনা হেফাজতেও ছিলেন এমন খবর বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া যায়। কিন্তু পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, ২৬ আগস্ট রাতে তিনি জার্মান বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর ডুসেলডর্ফের একটি রেস্টুরেন্টে যান খাবার খেতে। সেখান থেকে বেলজিয়ামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের বাসিন্দা জার্মান আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক মোবারক আলী ভূঁইয়া বকুল এ সময় তাকে সঙ্গ দেন।

হাছান মাহমুদ সেই থেকে বেলজিয়ামের লিমবুর্গ প্রদেশের হ্যাসেল্ট সিটিতে নিজের বাড়িতেই আছেন। বেলজিয়ামজুড়ে তার আরও চারটি বাড়ি আছে। তবে তিনি প্রায়ই যাওয়া-আসা করছেন লন্ডনে। সেখানে তার ছেলে সাফওয়ান মাহমুদ পড়াশোনা করেন।

গত বছর ১৯ ডিসেম্বর জার্মানির কোলনের উলিথজক্যাস্টরে আওয়ামী লীগের সভায় গিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়েন হাছান মাহমুদ। অনুষ্ঠানস্থলে তিনি উপস্থিত হওয়ার পরপরই স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি দল তার দিকে তেড়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের বর্তমান দুর্দশা ও দুর্নীতির অন্যতম কুশীলব হিসেবে সরাসরি তাকে দায়ী করেন। পরে জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে তিনি নীরবে সভাস্থল ত্যাগ করেন।

স্ত্রী-সন্তানরা পালায় ৪ আগস্ট রাতে
জুলাই গণঅভ্যূত্থানে শেখ হাসিনার পলায়নের আগের দিন ৪ আগস্ট রাতেই পালিয়ে যান হাছান মাহমুদের স্ত্রী নূরান ফাতেমা ও সন্তানরা। তারা ইকে ৫৮৬ নম্বর ফ্লাইটযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই পালিয়ে যান। সেখানে হাছান মাহমুদের ২০০ ভবনের আবাসন এরিয়া থাকার গুঞ্জন রয়েছে। তবে তার পরিবারের সদস্যরা থাকেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে।

ইউরোপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হাছান মাহমুদ
দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে হাছান মাহমুদ নির্বিঘ্নে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, জার্মান, লন্ডন ও বেলজিয়ামসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। চালিয়ে যাচ্ছেন দলীয় নানা কর্মসূচিও। যেখানে অনেক উচুস্বরে দিচ্ছেন বক্তৃতা। দিচ্ছেন উস্কানিমূলক নানা বিবৃতিও। যা দেশে অস্থীতিশীল পরিস্থিতি তৈরী করছে।

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, সর্বশেষ গত ২০ এপৃল যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ওটু এলাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুকের ছেলে ডা. সৈয়দ ফাইয়াজ রহমানের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেখা গেছে হাছান মাহমুদকে।

এর আগে গত ৩০ মার্চ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে দেখা গেছে লন্ডনের গ্যাংসহিল এলাকার আল-কালাম মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করতে। ঈদের নামাজ শেষে পরিচিতদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন তিনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে দেখা যায়, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক সৈয়দ ফারুকের সঙ্গে কোলাকুলি করছেন হাছান মাহমুদ। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন লন্ডনে পড়াশোনা করা তার ছেলে সাফওয়ান মাহমুদ। ছেলের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে লন্ডনে যান তিনি।

এর আগে ২১ ফেব্রুয়ারি বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইউনিভার্সিটি লিবর ডি ব্রাসেলসের (ইউএলবি) বাইরের একটি উঠানে শহীদ মিনারের একটি কাঠামো সঙ্গে করে নিয়ে এসে বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের পলাতক যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক হাছান মাহমুদকে।

এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের চার নেতা ও তাদের স্ত্রীরা। একুশের শোকাবহ দিনে উপস্থিত মোট সাত অংশগ্রহণকারীকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দেখা গেলেও হাছান মাহমুদ ছিলেন বিধ্বস্ত চেহারায়। তবে কমেনি তার গলার স্বর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে দেখা যায় উস্কানিমূলক নানা বিবৃতিও।

যেভাবে ভাগ্য খুলে হাছান মাহমৃুদের
২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকে ভাগ্য খুলে যায় হাছান মাহমুদের। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জয়লাভ করেন তিনি। এ সময় দলীয় শুভাকাঙ্খীদের অনুদান, প্রবাসী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করা চাঁদাবাজির টাকায় নির্বাচনের খরচ মেটান সে সময়ের নিংস্ব হাছান মাহমুদ।

এরপর ২০০৯ সালের মহাজোট সরকারের প্রথম ছয় মাস পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে জলবায়ু তহবিলের বিপুল অংকের টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। এমনকি বনবিভাগের বিপুল বনভুমি নিজের ভাই ও স্বজনদের নামে দখলে নেয়। কর্ণফুলী ও ইছামতি নদী থেকে বালু পাচার করে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায়ও তিনি তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এ সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা অবর্ণনীয় হামলা-মামলার শিকার হন। এ সময়ে অন্তত ২০০ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়।

সর্বশেষ তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। শুরু থেকে ১৫ বছর ধরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় তার নির্বাচনী এলাকায় নিজ দলের প্রতিবাদি নেতাকর্মী, দুর্নীতিবিরোধী মানুষ ও বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-নির্যাতন, মামলা দিয়ে হয়রানি করে চরম ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন হাছান মাহমুদ।

ঈশান/খম/মসু

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page