
পুলিশের কব্জায় এখন চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদের স্ত্রী নর্তকী শারমিন আক্তার তামান্না। শনিবার (১০ মে) রাত সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাটের বাড়ৈপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে বাকালিয়া থানা পুলিশ।
রবিবার (১১ মে) এ তথ্য জানান বাকলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. ইখতিয়ার উদ্দিন। তিনি জানান, চট্টগ্রামের আলোচিত জোড়া খুনের মামলায় এজাহারভুক্ত দুই নম্বর আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের স্ত্রী শারমির আক্তার তামান্না। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার দিনগত রাতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ওসি জানান, তামান্না দীর্ঘদিন ধরে আত্নগোপনে ছিলেন। কখনও ছদ্মবেশে বাসা বদল করে, কখনও পরিচয় গোপন করে আত্নীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। তার কাছ থেকে নৃশংস হত্যাকান্ডে জড়িত অন্যান্যদের স¤পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলতে পারে বলে আশা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য আদালতে তুলে তার রিমান্ড চাওয়া হবে।
পুলিশের তথ্যমতে, গত ৩০ মার্চ ভোর রাতে চট্টগ্রাম মহানগরীর বাকলিয়ার অ্যাক্সেস রোড এলাকায় ধাওয়া করে একটি প্রাইভেটকারকে থামিয়ে দুই জনকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন বখতিয়ার হোসেন মানিক ও মো. আবদুল্লাহ। এ ঘটনায় আহত হন আরও দুজন।
এর নেপথ্যের কারিগর হিসেবে নাম আসে সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের। আরেক সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন ও সাজ্জাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে এমনটি ঘটেছে বলে জানায় পুলিশ। মূলত সরোয়ারকে মারতেই সেই হামলা চালায় সাজ্জাদের লোকজন।
ঘটনার দু‘দিন পর ১ এপ্রিল বাকলিয়া থানায় নিহত বখতিয়ার হোসেন মানিকের মা ফিরোজা বেগম বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। তিনি অভিযোগ করেন, কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী তামান্নার পরিকল্পনায় খুনের ওই ঘটনা ঘটে। মামলায় সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী তামান্নার পাশাপাশি মো. হাসান, মোবারক হোসেন ইমন, রায়হান ও বোরহানকেও আসামি করা হয়।
মামলার পরে ৯ এপ্রিল হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পান সন্ত্রাসী সাজ্জাদের স্ত্রী তামান্না। বিচারপতি মো. মাহবুব উল আলম এবং বিচারপতি মো. হামিদুর রহমানের আদালত তার আগাম জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষ এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে ১৩ এপ্রিল আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. রেজাউল হক তামান্নাসহ তিনজনকে সাত দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্নসমর্পণের নির্দেশ দেন। কিন্তু তামান্না বিচারিক আদালতে আত্নসমর্পণ করেননি। তাই অভিযান চালিয়ে তামান্নাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর আগে গত ১৫ মার্চ রাতে রাজধানী ঢাকার বসুন্ধরা সিটি থেকে সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন থানায় খুন-চাঁদাবাজিসহ অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে। তাকে ধরতে সিএমপির পক্ষ থেকে পুরস্কারের ঘোষণাও দেওয়া হয়। এরপর এসব মামলায় ঢাকায় পালিয়ে ছিল সাজ্জাদ। বসুদ্ধরা সিটি থেকে গ্রেপ্তারের সময় তার স্ত্রী তামান্নাও সঙ্গে ছিল। তবে পুলিশের উপস্থিতি দেখে পালিয়ে যান তিনি। এরপর পরদিন তামান্না ফেসবুক লাইভে এসে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে স্বামী সাজ্জাদকে ছাড়িয়ে আনার ঘোষণা দেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিও বার্তায় তামান্না আরও বলেন, আমার জামাই গতকাল রাতে অ্যারেস্ট হইছে। এটা নিয়ে এতো হাই হুল্লাস করার কিছু নাই। মামলা যখন আছে, অ্যারেস্ট হবে। এগুলো নিয়ে এতো টেনশন করা, দুঃখ প্রকাশ করা, কান্নাকাটি করার কিছুই নাই। আপনারা যারা ভাবতেছেন আমার জামাই অ্যারেস্ট হইছে, আর কোনোদিন বের হতে পারবে না, ওদের জন্য এক বালটি সমবেদনা। এখন যারা এই ঘটনা ঘটাইছে, তাদেরকে ছাড় দেওয়া হবে না; মাথায় রাইখো। এতোদিন আমরা পলাতক ছিলাম, এখন তোমাদের পলাতক থাকার পালা। আমার জামাই আইনি প্রক্রিয়া শেষে আমার কাছে আসবে। তখন খেলা শুরু হবে। খেলা শুরু করছো তোমরা, শেষ করবো আমরা। আমার জামাই সাজ্জাদের যারা সাপোর্টার আছো সবাই দোয়া করবা, যাতে ১০-১২ দিনের মধ্যে জামিন করাই ফেলতে পারি।
এরপর ৮ এপ্রিল হত্যা মামলায় রিমান্ডে থাকা ছোট সাজ্জাদকে সঙ্গে নিয়ে রাউজান ও বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় মাইকিং করে পুলিশ। তাকে রাস্তায় ঘুরিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি করে পুলিশের এ মাইকিংয়ের ঘটনায় চটেন স্ত্রী তামান্না। এ ঘটনার পরদিন নিজের ফেইসবুক পেইজ থেকে একটি ভিডিও বার্তায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তামান্নার অভিযোগ করেন, তার স্বামী সাজ্জাদকে কোরবানির গরুর মতো রশি বেঁধে রাস্তায় ঘোরানো হয়েছে। এটা অপমানজনক এবং তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এর আগে সাজ্জাদ ফেসবুক লাইভে এসে নগরীর বায়েজীদ থানার ওসিকে ন্যাংটা করে পিটুনির হুমকি দেয়।
কে এই তামান্না :
চট্টগ্রাম মহানগরীর সদরঘাট থানার মাদারবাড়ি এলাকায় বেড়ে উঠা শারমিন আক্তার তামান্নার। সেখানে থাকেন তার মা-বাবা। কিন্তু তাদের কেউ তামান্নাকে মেয়ে বা সন্তান বলে পরিচয় দিতে নারাজ। তাই তামান্নার এখন একমাত্র পরিচয় চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের স্ত্রী।
এলাকাবাসীর মতে, মুরগির দোকানের কর্মচারী থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী তকমা পাওয়া ছোট সাজ্জাদ যেমন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে স্ত্রী তামান্নাও তেমনই। বরং স্বামীর চেয়ে স্ত্রী আরও এক ধাপ এগিয়ে। তামান্নার বয়স এখন ৩৫। তামান্না সাজ্জাদকে বিয়ে করেন ৭ মাস আগে। রাউজানের একটি মসজিদে কাজী ডেকে তাদের বিয়ে পড়ানো হয়। এটি তামান্নার তৃতীয় বিয়ে আর সাজ্জাদের দ্বিতীয়। সাজ্জাদ প্রথমে শিলা নামে তৃতীয় লিঙ্গের একজনকে বিয়ে করে। শিলার বাড়ি হাটহাজারী উপজেলায়। তবে সে তৃতীয় লিঙ্গের হওয়ায় পরিবারের সঙ্গে হাটহাজারীতে বসবাস করত না।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়া এলাকা থেকে তার গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। শিলা কাউখালী উপজেলার তৃতীয় লিঙ্গের লিডার হিসাবে পরিচিত ছিল। চার-পাঁচ বছর আগে শিলা সার্জারি করে শারীরিক পরিবর্তন ঘটানোর পর বিভিন্ন রকম স্টেজ শো করত। তামান্নাও পেশায় ছিলেন নর্তকী। দুবাইয়ের বিভিন্ন নাইট ক্লাবে ড্যান্স করেন তিনি। ট্যুরিস্ট ভিসায় একবার দুবাই গিয়ে তিন মাস থাকেন। বিভিন্ন নাইট ক্লাবে ড্যান্সার হিসাবে চাকরি করেন। এরপর আবার দেশে ফিরে আসেন।
তামান্নার পরিবার সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০২২ সালের পর ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাইয়ে যায় তামান্না। বিভিন্ন ক্লাবে নাচত। শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদও দুবাই যায়। সেখানে ড্যান্স ক্লাবে তাদের পরিচয় হয়। মোবাইল নম্বর দেওয়া-নেওয়া হয়। মাঝে-মধ্যে মোবাইল ফোনে তাদের মধ্যে কথা হতো। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝামেলার কারণে ২০২৩ সালের দিকে তাদের মাঝে স¤পর্কের অবনতি ঘটে। তখন প্রায় ছয় মাসের মতো কথা বলা বন্ধ ছিল। ২০২৪ সালের শুরুতে আবার স¤পর্ক উষ্ণ হয়।
এর মধ্যে গত বছরের ২৯ আগস্ট নগরের বায়েজিদ বোস্তামি থানার অক্সিজেন কুয়াইশ সড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে মাসুদ কায়সার (৩২) ও মোহাম্মদ আনিস (৩৮) নামে দুজনকে হত্যা করে সাজ্জাদ। এরপর রাউজান এলাকায় পালিয়ে যায়। পালিয়ে থাকা অবস্থাতেই তামান্নাকে বিয়ে করে সাজ্জাদ। এরপর অক্সিজেন এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বাস করত তারা দুজন।
পারিবারিক সূত্র আরও জানায়, তামান্না প্রথম বিয়ে করে ২০০৭ সালের দিকে। ওই ঘরে রোহান নামে ১৭ বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। এরপর ২০১৮ সালের শেষের দিকে আরও একটি বিয়ে করে তামান্না। এ ঘরে একটি সন্তান রয়েছে। আগের দুই স্বামীই সামাজিকভাবে ভালো মানুষ হিসাবে পরিচিত। তামান্নার সঙ্গে প্রথম স্বামীর তেমন যোগাযোগ নেই। তবে পরের স্বামীর সঙ্গে এখনো যোগাযোগ রয়েছে।
আর সাজ্জাদ ছোটকাল থেকে অসহায় অবস্থায় বড় হয়েছে। ছোটকালে তার মা-বাবা মারা যায়। এরপর নজু মিয়ারহাট এলাকায় একটি মুরগির দোকানে কর্মচারী হিসাবে চাকরি নেয় সাজ্জাদ। কয়েক বছর ওই দোকানে চাকরি করে। পরে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে চট্টগ্রামের এক সময়ের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খানের অনুসারী হিসাবে। তাই তাকে অনেকে ছোট সাজ্জাদ বলে ডাকে। সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ তার এই অপকর্মের কাহিনী তুলে ধরেন।