
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে উদ্বোধনের পর মাস না যেতেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সীতাকুন্ড-সন্দ্বীপ ফেরি সার্ভিস। ফলে ফের দুর্ভোগের যুগে ফিরে গেছে সন্দ্বীপবাসী। এতে ক্ষোভে ফুঁসছেন দ্বীপের মানুষ।
উত্তাল সাগরে ঝড়ের অজুহাতে দুর্ঘটনা কবলিত হওয়ার শঙ্কায় সোমবার (২১ এপৃল) সন্ধ্যায় ফেরি সার্ভিস বন্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)।
বিআইডব্লিউটিসির চট্টগ্রাম জোনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার গোপাল চন্দ্র মজুমদার মঙ্গলবার (২২ এপৃল) দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ১৫ এপৃল থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সাগর উত্তাল থাকে। এসময় সাগর পাড়ি দিয়ে এই ফেরি চলাচল সম্ভব নয়। বর্তমানে এই ফেরি চলাচল করছে চরম ঝুঁকি নিয়ে। সম্প্রতি ঝড়ের কবলে পড়ায় এই ফেরি সার্ভিস সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এর আগে উত্তাল সাগরে ফেরি চালালে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। তাই ফেরি চলাচল বন্ধ রাখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে সরকারের কোনোরকম নির্দেশনা মেলেনি এখনও। সরকারি নির্দেশনা এলে এই ফেরি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে।
বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা জানান, সীতাকুন্ড-সন্দ্বীপ রুটের ১৩ কিলোমিটার সাগরে চলাচলের মতো উপযোগী ফেরি বিআইডব্লিউটিসির নেই। সীতাকুন্ড-সন্দ্বীপ রুটে যে ফেরি চালু করা হয়েছে, তা নদীপথের জন্য তৈরি করা। সাগর পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতা নেই। সরকারের আগ্রহে চাঁদপুর থেকে কপোতাক্ষ নামের একটি ফেরি এনে সীতাকুন্ড-সন্দ্বীপ রুটে ফেরি সার্ভিস চালু করা হয়েছে। তবে এপৃল থেকে এ রুটে এই মানের ফেরি চলাচল বিপজ্জনক।
এদিকে বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষও (বিআইডব্লিউটিএ)। সংস্থাটির চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী ফেরি না থাকায় উদ্বোধনের মাত্র এক মাসের মাথায় বন্ধ রাখা হয়েছে এই ফেরি চলাচল। কারণ বর্তমানে যে ফেরিটি চলছে, তা নদীতে চলাচল উপযোগী। এপৃলের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সন্দ্বীপ চ্যানেলের মতো উত্তাল সমুদ্রে এই ফেরি চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সন্দ্বীপের প্রায় চার লাখ অধিবাসী যাতায়াতের জন্য ¯িপডবোট বা ছোট্ট নৌকার ওপর নির্ভরশীল। তাও জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। তাই দীর্ঘদিন ধরে তাদের যাতায়াতের কষ্ট লাঘবের দাবি জানিয়ে আসছিলেন বাসিন্দারা।
সন্দ্বীপের বাসিন্দা ফাওজুল কবির খান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগ পাওয়ার পর চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ রুটে ফেরি চলাচলের উদ্যোগ নেন। উপদেষ্টা নিজেই তদারকি করেন এ প্রকল্পের কাজ। এই ফেরি সার্ভিসটি ঘিরে দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের সঙ্গে চট্টগ্রামের মূল ভূখন্ডের যোগাযোগের চরম দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবেন বলে আশায় বুক বেঁধেছিলেন সন্দ্বীপবাসী। এই ফেরি সার্ভিস বন্ধ হওয়ার খবরে ফের দুর্ভোগের যুগের কথা স্মরণ করছে সন্দ্বীপের মানুষ। ফুঁসছেন ক্ষোভে।
সন্দ্বীপের সমাজকর্মী ফাহাদ চৌধুরী বলেন, এখানে আবহাওয়ার ব্যাপারটা অজুহাত, সেটা আমরা বুঝি। ফেরি চলাচল বন্ধে কাজ করছে সিন্ডিকেট। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, দ্বীপবাসীকে ফের অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়ে জিম্মী করা। দ্বীপবাসীর দাবি-ফেরি বন্ধ থাকলেও এটি যেন অন্য রুটে পাঠানো না হয়। সন্দ্বীপেই নোঙর করে রাখা হোক, আবহাওয়া ভালো হলে আবার চালু হোক।
উপজেলার বাসিন্দা কামাল উদ্দিন বলেন, স্পিডবোট আর নৌকায় উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে যাতায়াত করতে হতো সন্দ্বীপে। অসুস্থ মানুষ নিয়ে সাগর পাড়ি দেওয়ার নিশ্চয়তা পর্যন্ত ছিল না। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই অনিরাপদ যাতায়াতে ২২টি প্রাণ ঝরে গেছে। এ কারণে সন্দ্বীপের মানুষ অধিকাংশই সন্দ্বীপে থাকতো না। কিন্তু ফেরি সার্ভিস চালু হওয়ার পর স্বস্তি ফিরেছে, বেড়েছে যাতায়াত। আবার ফেরি সার্ভিস বন্ধ হওয়ার খবরে সাধারণ মানুষ খুবই হতাশ। তারা ফের দুর্ভোগের যুগের কথা স্মরণ করছেন।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই তড়িঘড়ি করে চালু করা হয়েছে ফেরি সার্ভিস। এতে প্রায় ২০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সড়ক বিভাগ, বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসি আলাদাভাবে নিজস্ব মেরামত ও রাজস্ব তহবিল থেকে টাকা খরচ করে বাস্তবায়ন করেছে প্রকল্পটি। কিন্তু এ প্রকল্প থেকে আশানুরূপ সুফল পাবে না দ্বীপবাসী।
বিআইডব্লিউটিএ জানায়, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া উপকূলে বেড়িবাঁধ থেকে সমুদ্রের প্রায় ৭০০ মিটার গভীর পর্যন্ত দুই লেনের প্রশস্ত একটি সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। একইভাবে সন্দ্বীপ উপজেলার গুপ্তছড়া উপকূলে নির্মাণ করা হয়েছে ৬০০ মিটারের আরেকটি সড়ক। যা গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো রকম পূর্বপরিকল্পনা ও সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া সমুদ্রের টাইডাল জোনে নির্মাণ করা হয়েছে সড়কটি। গত ২৪ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের সাত উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার দুজন বিশেষ সহকারীর উপস্থিতিতে ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন করা হয় সীতাকুন্ড-সন্দ্বীপ রুটের ফেরি সার্ভিস।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামে বিআইডব্লিউটিসির ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) আব্দুর নুর তুষার বলেন, সমুদ্রে চলাচল উপযোগী ফেরি নির্মাণের চিন্তা করছে সরকার। বিদেশ থেকে নকশা এনে তা বাংলাদেশেই নির্মাণ করা হবে। এই কোস্টাল ফেরি নির্মাণ-সংগ্রহের জন্য এরইমধ্যে প্রকৌশলীদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।