
বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট খাতে ভয়াবহ প্রতারণার এক প্রতিচ্ছবি ভাইয়া হাউজিং লিমিটেড। যারা পতিত ফ্যাসিবাদ সরকারের ছত্রছায়ায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা। নিংন্ব হয়ে এদের অনেকে এখন আইনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন টাকা ফেরতের আশায়। কিন্তু প্রতাপশালী এই চক্র এখন উল্টো ভয় দেখাচ্ছে ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের।
এমন অভিযোগ ভাইয়া হাউজিং চক্রের প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগী সহজ সরল সাধারণ মানুষ। ফলে নিরুপায় হয়ে ভুক্তভোগী মানুষ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র নিয়ে এখন গণমাধ্যমের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। এর মধ্যে প্রতারণার প্রমাণ হিসেবে চুক্তিপত্র, জাল কাগজপত্র, জমির মালিকানা সম্পর্কিত জাল ডকুমেন্ট এবং আর্থিক লেনদেনের রেকর্ড মিলেছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্লট, ফ্ল্যাট, হোটেল, রিসোর্ট, হাসপাতাল ও বাণিজ্যিক ভবনের নামে হাজারো সাধারণ মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়ে ভাইয়া হাউজিং এখন গড়ে তুলেছে বিশাল সাম্রাজ্য। যার আওতায় পরিচালিত হচ্ছে রুপালী বাংলাদেশ নামে একটি সংবাদপত্রও।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, ভাইয়া হাউজিংয়ের প্রতারক চক্র এখন সংবাদপত্রে নিউজ প্রকাশের ভয় প্রদর্শন করছেন ভুক্তভোগীদের। এই প্রতিষ্ঠানটি কেবল একটি হাউজিং কোম্পানি নয়—বরং এটি একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেট, যার মূল শক্তি ছিল ফ্যাসিবাদি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কতিপয় প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি ও নেতাকর্মী। এছাড়া ফ্যাসিবাদের সমর্থক তারকাদের ব্র্যান্ড ব্যবহার, সুন্দরি নারীর প্রলোভনসহ বহুমুখী জালিয়াতির ফাঁদ তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি।
এর মধ্যে দেশের স্বনামধন্য নাবিস্কো গ্রুপের নাম ব্যবহার করে আস্থার ফাঁদ তৈরি করে এই ভাইয়া হাউজিংয়ের প্রতারক চক্র। ভাইয়া হাউজিং দাবি করে এসেছে—তারা নাবিস্কো গ্রুপের একটি সহপ্রতিষ্ঠান। বিস্কুট, চিপসসহ নাবিস্কো ফুড পণ্য উপহার দিয়ে তারা ক্লায়েন্টদের মাঝে বিশ্বাসও তৈরির চেষ্টা করেছে। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে—তাদের সঙ্গে নাবিস্কো গ্রুপের কোনো আইনি বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। এটি ছিল নিছকভাবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করার এক কৌশল।
প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান চেয়ারম্যান এর আগেও জড়িত ছিলেন আরেকটি হাউজিং প্রকল্পে, যেখানে দুর্নীতি, জমির জাল কাগজপত্র এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল। সেই মামলাগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবে থেমে যায়। এবারও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশের ডিজিএফআই, এনএসআইয়ের প্রভাব বিস্তার করছে প্রতিষ্ঠানটির প্রতারক চক্র। এমনকি ভাইয়া গ্রুপের গণমাধ্যম রুপালী বাংলাদেশ ডিজিএফআই পরিচালনা করছে বলে প্রচার করছে প্রতারক চক্র।
সাম্প্রতিক সময়ে ভাইয়া হাউজিং-এর প্রতারণার আরেকটি নতুন ও চাতুর্যময় কৌশল হলো—জনপ্রিয় তারকাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে ব্যবহার। বাংলাদেশের খ্যাতনামা ক্রিকেটার, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও মডেলদের ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে তারা সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে বিনিয়োগে উৎসাহিত করে।
অনেক বিজ্ঞাপনে দেখা যায় জনপ্রিয় তারকা কোনো প্রকল্পের পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, ভাইয়া হাউজিং-এর সাথে আমি আছি, আপনি আছেন তো? এই তারকাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তারা অধিকাংশ সময় প্রকল্পের আইনি ও বাস্তব দিক সম্পর্কে অবগত নন। পরে দেখা যায়, তারকারাও প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন, বা অনেকেই জানেনই না যে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে।
ভাইয়া হাউজিং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস অর্জনে আরেকটি চাতুর্যময় পন্থা অবলম্বন করেছে— সেটি হলো বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পোর্টালে টাকার বিনিময়ে পজেটিভ সংবাদ প্রকাশ ও অনুষ্ঠান সম্প্রচার।
ভুয়া প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, রিসোর্ট ভিজিট বা তারকাদের অংশগ্রহণে আয়োজন করা হয় ‘বিশ্বস্ততা’র মঞ্চ। এসব অনুষ্ঠান ও সংবাদে প্রকল্পগুলোর সাফল্য ও ভবিষ্যৎ লাভজনকতা তুলে ধরে বিনিয়োগকারীদের প্রতারিত করা হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক গণমাধ্যম কর্মী নিজের অজান্তে এই প্রচারণায় অংশ নিলেও, কেউ কেউ সরাসরি আর্থিক লেনদেনে যুক্ত ছিলেন। এভাবে ভাইয়া হাউজিং বিভিন্ন ভুয়া প্রকল্পে প্লট ও রিসোর্ট শেয়ার বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা। আর প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতির প্রমাণও মিলেছে। এর মধ্যে পাইন সিটির (পূর্বাচল) নামে মালিকানাহীন জমিতে বিক্রি হয়েছে ১৮০০টিরও বেশি প্লট।
টিউলিপ ভ্যালি: পুরনো ‘বেস্টওয়ে হাউজিং’ প্রকল্পের নতুন রূপ; জমি এখনো মর্টগেজে। বীরতারা সিটির (মাওয়া) জলাবদ্ধ জমির কোনো অবকাঠামোর উন্নয়ন শুরুই হয়নি। ইডেন বে (কক্সবাজার) রিসোর্ট প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা তোলা হলেও এখনো একটি ইটও বসেনি। Greenwich Station (সিলেট): পর্যটন প্রকল্পের ঘোষণা থাকলেও কোনো দৃশ্যমান কাজ নেই।
প্রকল্পের জমিগুলো অধিকাংশই বিতর্কিত বা তৃতীয় পক্ষের মালিকানায়। প্রশাসন ও স্থানীয়রা বহুবার অভিযোগ জানালেও প্রতারকরা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে এসব বিষয়ে পাওয়া অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করছে, যদিও এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি প্রতিষ্ঠানটির প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে।
ভাইয়া হাউজিং-এর বিক্রয় টিমে রয়েছে ৫০০-এরও বেশি প্রতিনিধি, যাদের অধিকাংশই সুদর্শন নারী। তাদের প্রধান কাজ ছিল মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ আমলা এবং VIP ক্লায়েন্টদের প্রলুব্ধ করে অর্থ বিনিয়োগ করানো। একজন সাবেক নারীকর্মীর বলেন, বাস্তবতা দেখানো নিষেধ ছিল। আমাদের বলা হতো—স্বপ্ন বিক্রি করো, বাস্তবতা নয়। এভাবে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
আর এসব নারীদের ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করে বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়া হতো। ফলে পূর্ববর্তী সরকারের সময় ভাইয়া হাউজিংয়ে বিনিয়োগ করেন অনেক—মন্ত্রী, ব্যবসায়ী ও আমলারাও। সরকার পরিবর্তনের পর তারা মুখ বন্ধ করে আছেন বা দেশ ত্যাগ করেছেন। আবার প্রশাসনিক সংশ্লিষ্টতায় প্রকাশ্যে কিছু বলতেও পারছেন না। তাদের কেউ কেউ অর্থ ফেরতের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। এভাবে হাজার হাজার পরিবার আজ নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে। পেনশনের টাকা, শেষ সম্বল বিক্রি করে তারা এখন শুধু বিচার চায়।
সূত্র জানায়, ভাইয়া হাউজিং-এর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। তারা বহুবার প্রতিশ্রুতি দিলেও প্রকল্প হস্তান্তরের কোনো নজির নেই। এর মধ্যে রাজারবাগ বাণিজ্যিক ভবন প্রকল্প (২০১৩): আজও হস্তান্তর হয়নি। মধুমতি মডেল টাউন (সাভার): আদালতের রায়ে অবৈধ ঘোষণা, পরে নতুন নামে চালু ‘নান্দনিক হাউজিং’ হিসেবে, যেখানে চলছে আগের মতোই প্রতারণা।
এ বিষয়ে জানতে ভাইয়া হাউজিংয়ের চেয়ারম্যান ও এমডি-র সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা নানা অজুহাতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি একাধিকবার ফোন করলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।
এ পরিস্থিতিতে ভাইয়া হাউজিং যেন আর প্রতারণা করতে না পারে এবং তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে অন্তবর্তি সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিকট আকুল আবেদন জানানো হয়েছে।