সোমবার- ১৮ আগস্ট, ২০২৫

মহিউদ্দিন বাচ্চুর ভাই বেলালের পেটে কেজিডিসিএল!

মহিউদ্দিন বাচ্চুর ভাই বেলালের পেটে কেজিডিসিএল!

# নিয়োগ-পদোন্নতি, গ্যাস সংযোগ মিলে তাঁর ইশারায়
# গড়েছেন পাহাড়সম অঢেল সম্পদ
# জুলাই আন্দোলনে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ

ট্টগ্রাম-১০ আসনের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য কুখ্যাত সন্ত্রাসী মহিউদ্দিন বাচ্চু। তার ভয়ে চট্টগ্রামের তেপান্তরে পানি খাওয়া হতো না বাঘে-মহিষেরও। এ সুবাধে একচ্ছত্র প্রভাব খাটিয়ে বিগত ১৬ বছর গিলে খেয়েছে চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

তাদের অন্যতম একটি কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। ছাত্র জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পলাতক রয়েছেন মহিউদ্দিন বাচ্চু। কিন্তু তারই যোগ্য উত্তরসূরি ছোট ভাই বেলাল উদ্দিন ঠিকই গিলে খাচ্ছে কেজিডিসিএল।

তার ভয়ে এখনও মুখ খুলে কথা বলতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটির এমডি থেকে কোন কর্মকর্তা। যা স্বীকার করারও জো নেই কারও। মিলেছে তার প্রমাণও। গত রবিবার (১০ আগস্ট) প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সালাহ উদ্দিনের সাথে বেলাল উদ্দিনের দূর্নীতির বিষয়ে কথা বলতে গেলে পড়তে হয় বিপত্তিতে।

পরিচয় দিয়ে এমডির সাথে কথা বলতে এপয়নমেন্ট নিতে হয় উপ ব্যবস্থাপক (সমন্বয়) সুলতান মাহমুদের কাছ থেকে। কিন্তু এমডির সাথে কি কথা বলব, তার কৈফিয়ত চান তিনি। না বলায় প্রায় ২০ মিনিট বসিয়ে রাখার পর তিনি বলেন, এমডি সাহেব মিটিংয়ে বসেছেন, কথা বলতে ঘন্টা-দু‘ঘন্টা এমনকি আরও বেশি সময় লাগতে পারে।

এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আপনি ৮ম তলায় জনসংযোগ ও সমন্বয়ক ডিপার্টমেন্টের উপমহাব্যবস্থাপক বেলাল উদ্দিনের সাথে কথা বলুন। যার বিষয় নিয়ে এমডি সাহেবের সাথে কথা বলতে এসেছি, তাঁর সাথে কেন কথা বলব? এমন প্রশ্নের জবাবে নিরব ভুমিকা পালন করেন সুলতান মাহমুদ। এ থেকে বুঝা যায় প্রতিবেদকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত আছেন তিনি। যা থেকে সহজেই অনুমেয় বেলাল উদ্দিনের প্রভাব সম্পর্কে।

এ নিয়ে সম্প্রতি দূর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব বরাবরে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন প্রতিষ্ঠানটির ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদাররা। যেখানে কেজিডিসিএল থেকে লুটের অর্থ দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার তথ্য উপস্থাপন করে বেলাল উদ্দিনের কবল থেকে কেজিডিসিএলকে রক্ষার আকুল আবেদন জানানো হয়েছে।

আরও পড়ুন :  জ্বালানি তেল পরিবহনে নতুন যুগে বাংলাদেশ

অভিযোগ থেকে জানা গেছে, সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর ছোট ভাই মো. বেলাল উদ্দিন বর্তমানে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড (কেজিডিসিএল) এর জনসংযোগ ও সমন্বয়ক ডিপার্টমেন্টের উপমহাব্যবস্থাপক পদে কর্মরত আছেন। নিয়োগের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় মহিউদ্দিন বাচ্চুর নেতৃত্বে অস্ত্রের মুখে রাতের আঁধারে বোর্ড বসিয়ে এই পদোন্নতি দিতে বাধ্য হন কেজেডিসিএল কর্তৃপক্ষ। যা সংশ্লিষ্ট সবাইকে হতবাক করেছে।

শুধু বেলাল নয়, এ সময় একই সাথে মোট ৩২ জনের পদোন্নতি বাগিয়ে নেন মহিউদ্দিন বাচ্চু। এ জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫-৬ লাখ টাকা করে প্রায় দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। আর এই ঘটনার মুল কারিগর ছিলেন বেলাল উদ্দিন। শুধু পদোন্নতি নয় ২০১০ সালে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আলোকে বেলাল উদ্দিনের নিয়োগও হয়েছিল সন্ত্রাসী কায়দায়। তখনও তৎকালীন এমডি সানোয়ার হোসেন ও জি এম এডমিন আহসান হাবীবকে পিস্তলের মুখে বেলালসহ ৫৭ কর্মকর্তার নিয়োগ আদায় করেন মহিউদ্দিন বাচ্চু।

অথচ নিয়োগপ্রাপ্তরা কেউ এই নিয়োগ পরীক্ষায় পাশ করেনি। কেউ ভাইভা দেয়নি। আবেদনে অনেকের ব্যাংক ড্রাফট পর্যন্ত ছিল না। এ কাজে মহিউদ্দিন বাচ্চু হাতিয়ে নেন প্রায় ১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেলাল উদ্দিনের সনদ জালিয়াতিও রয়েছে।

জাল সনদে নিয়োগ পাওয়া সেই বেলাল রাতারাতি হয়ে উঠে কেজিডিসিএলের অঘোষিত এমডি। তার কথার বাইরে এক চুল, এমনকি নিশ্বাসও ফেলতে পারত না প্রতিষ্ঠানের এমডির পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এ সুবাধে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্প কাজের টেন্ডার থেকে লুটেছেন ১০% কমিশন। অফিসের স্টেশনারী ক্রয় থেকে এমন কোন বিল বাদ যায়নি সে লুটপাট করেনি। ঠিকাদার নিয়োগ, কার্যাদেশ পাওয়া সবকিছুই ছিল তার হাতের মুঠোয়। দলীয় লোকজন ও মোটা অঙ্কের টাকা ছাড়া নগরবাসীর কারও জুটত না গ্যাস সংযোগ। সুযোগ বুঝে একজনের গ্যাস লাইন খুলে এনে ৫/৭ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিত পছন্দের কারও কাছে।

আরও পড়ুন :  জ্বালানি তেল পরিবহনে নতুন যুগে বাংলাদেশ

এছাড়া সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ ও শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের আজ্ঞাবহ হয়ে ছাত্রলীগের দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে কেজিডিসিএলে চাকরি দিয়েছেন বেলাল উদ্দিন। যাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে হাতিয়েছেন ২০/২৫ লাখ টাকা করে। এভাবে নিয়োগ বাণিজ্য, পদোন্নতি বাণিজ্য, গ্যাস লাইন সংযোগ বাণিজ্যে বিগত সময়ে ফুলে ফেঁপে উঠে দু‘ভাই। চট্টগ্রামে গড়ে তোলে পাহাড়সম সম্পদ।

চট্টগ্রাম লালখান বাজার ও ওয়াসা মোড়ের পেট্টোল পাম্পের পাশে বিশাল প্লট কিনে গড়ে তোলে বিলাসবহুল ৫ তলা বাড়ি। যার বাজার মূল্য কয়েকশত কোটি টাকা। এছাড়া নগরীর অভিজাত খুলশী এলাকায় কিনেছেন বিশাল প্লট, যেখানে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে।

এ অবস্থায় গত বছর জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালানোর জন্য ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন বেলাল উদ্দিন ও মহিউদ্দিন বাচ্চু। ছাত্রলীগের হাতে তুলে দেন কাড়ি কাড়ি টাকা। বেলাল উদ্দিন ৩ আগষ্ট ছাত্রদের হত্যার উদ্দেশ্যে সিএনজি যোগে অস্ত্র নিয়ে নিজ বাসভবনে বিলি করে। ৪ আগস্ট ২০২৪ তার বড় ভাই এমপি বাচ্চু চট্টগ্রাম নিউমার্কেট এলাকায় অস্ত্র হাতে নিজে গুলি করে ছাত্রদের উপর।

তবে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বড় ভাই মহিউদ্দিন বাচ্চু গা ঢাকা দেওয়ায় নগরীর বিভিন্ন এলাকায় দখলবাজি, চাঁদাবাজি হাতবদল হলেও নিয়মিত চাকরি করে আগের মতোই কেজিডিসিএল থেকে লুটে যাচ্ছে বেলাল উদ্দিন। এমনকি সরকারি চাকরি বিধি লঙ্ঘন করে শুরু থেকে অদ্যাবধি বাড়ির পাশেই চাকরি করে যাচ্ছেন বেলাল উদ্দিন। এসব নিয়ে কেজিডিসিএলের কর্মকর্তাদের অনেকেই ক্ষিপ্ত। কিন্তু ভয়ে মুখ খুলছে না কেউ। বিষয়টি তদন্ত করলে বেলাল উদ্দিনের লুটে খাওয়া অর্থ ও গড়ে তোলা সম্পদের হিসাব পাওয়া যাবে বলে নিশ্চিত করেন অভিযোগকারীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত বেলাল উদ্দিন বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সব মিথ্যা। যারা অভিযোগ তুলেছে তাদের বলুন সত্যতা প্রমাণ করতে। সত্যতা প্রমাণ ছাড়া আপনি নিউজ করতে পারবেন না। আমি মহিউদ্দিন বাচ্চুর ভাই, এটি ছাড়া আপনি অন্য কিছু লিখলেও আমার কিছুই হবে না। তবে প্রশ্নের জবাবে তিনি খুলশী এলাকায় চার গন্ডা জমি ক্রয়ের কথা স্বীকার করেন।

আরও পড়ুন :  জ্বালানি তেল পরিবহনে নতুন যুগে বাংলাদেশ

প্রশ্নের উত্তরে বেলাল উদ্দিন বলেন, অনিয়ম আমি করিনি। বরং অনিয়ম করতে না দেওয়ায় আমার ওপর অনেকেই ক্ষিপ্ত। এর মধ্যে তিনি কয়েকজনের নামও বলেন। আবার বলেন, আমি তাদের সাথে কথা বলেছি। তারা এসব আর করবে না বলে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারপরও এসব করছে এরা। বিষয়টি আমি দেখব।

এ বিষয়ে জানতে কেজিডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. সালাহ উদ্দিনের কার্যালয়ে গিয়ে কথা বলায় নানা বিপিত্তির পর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি মুঠোফোনের কলও রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে কেজিডিসিএলের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের ভাষ্য, যে কোন দূর্নীতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ কর্মকর্তারা সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে চান না, দূরে থাকতে চান-এটাই নিয়ম। বরং সাংবাদিক যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য কর্মচারী দিয়ে হাই সিকিউরিট গড়ে তোলেন তারা। তম্মধ্যে কেজিডিসিএল অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান। যার পুরো নিয়ন্ত্রণ মহিউদ্দিন বাচ্চুর ছোট ভাই বেলাল উদ্দিনের হাতে। তাঁকে কেজিডিসিএল থেকে না সরানো পর্যন্ত লুটপাট চলবেই।

(বি: দ্র: গ্যাস সংযোগ পেতে কেজিডিসিএলে নানা অনিয়ম ও দূর্ভোগে অতিষ্ঠ চট্টগ্রামের মানুষ। কিন্তু এই অনিয়ম-দূর্নীতির অন্তরালে লুকিয়ে আছে চট্টগ্রামের প্রভাবশালী আওয়ামী পরিবারের সন্তান মহিউদ্দিন বাচ্চুর ছোট ভাই বেলাল উদ্দিন। সে কীভাবে দূর্নীতি করে মানুষের পকেট খালি করে নিজের আখের গোচাচ্ছে, তা নিয়ে পাঠকপ্রিয় দৈনিক ঈশান-এ প্রকাশিত হলো ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব। প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ হবে শীঘ্রই। লোমহর্ষক প্রতিবেদন পড়তে পাঠকরা চোখ রাখুন দৈনিক ঈশান এর প্রিন্ট ও অনলাইন সংস্করণে) 

ঈশান/বেবি/মখ

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page