সোমবার- ১৩ অক্টোবর, ২০২৫

শেখ হাসিনার মদদপুষ্ট দেলোয়ার

সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও তিনি রিহ্যাব চেয়ারম্যান!

সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও তিনি রিহ্যাব চেয়ারম্যান!

ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক নানা সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তন এলেও আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবে বহাল তবিয়তে রাজত্ব করছেন স্বৈরাচারের মদদপুষ্টরা। এর মধ্যে শেখ হাসিনার অন্যতম মদদপুষ্ট নেতা হলেন রিহ্যাব চট্টগ্রাম রিজিওনালের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন।

আওয়ামী লীগের আমলে প্রভাবশালী নেতা এবং ওবায়দুল কাদেরের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার। বর্তমানে তিনি একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। এরপরও তিনি রিহ্যাবের ব্যানারে বিভিন্ন সংস্থার বৈঠকে নিয়মিত হাজির হচ্ছেন। যুক্ত হচ্ছেন সভা-সমাবেশে।

চলতি বছরের ১৭ জুলাই ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি মামলা (সিআর-১৪১/২৫) দায়ের করেন ঢাকার বাসিন্দা মো. আশরাফুল। ওই মামলায় ৮ নম্বর আসামি দেলোয়ার হোসেন। মামলায় দেলোয়ার হোসেনকে ভারতীয় ‘র’ এর এজেন্ট, আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদেরের ব্যক্তিগত ক্যাশিয়ার এবং আজিমপুর হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ও আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে স¤পৃক্ত বলে অভিযোগ আনা হয়।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান একই মামলার ১৫ নম্বর আসামি। সালমান এফ রহমান কারাগারে গেলেও তারচেয়েও দাপুটে মামলার ৮ নম্বর আসামি দেলোয়ার হোসেন প্রকাশ্যে ঘুরছেন! অন্যদিকে চলতি বছরের ২৩ জুলাই বাড্ডা থানায় আরেকটি মামলা (৩৭৬/২৫) দায়ের করেন সাবেক সেনা সদস্য মো. খলিলুর রহমান।

শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে করা এই মামলায় ১৬ নম্বর আসামি করা হয় দেলোয়ার হোসেনকে। ওবায়দুল কাদের একই মামলার ১৫ নম্বর আসামি। এরপরও পুলিশের নাকের ডগায় প্রকাশ্যে ঘুরছেন দেলোয়ার হোসেন। যা সত্যিই বিস্ময়কর।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, সরকারি-আধাসরকারি কোনো সংস্থায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি কোনো পদে থাকতে পারবেন না। কোনো বেসরকারি সংগঠন হলে সেখানে গঠনতন্ত্রে কী আছে সেটা দেখতে হবে। তবে এটা তো নৈতিক স্খলন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালত দ্বারা প্রমাণিত। সে এখন ফেরারি, তাকে পুলিশ খুঁজবে। তার পদে থাকার কোনো সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন :  নির্বাচন কমিশন প্রতীকের সংখ্যা বাড়াতে-কমাতে পারে : সিইসি

তিনি জানান, রিহ্যাব চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে কর্মকান্ডের কারণে তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়। দেলোয়ার হোসেন ২০২৪ সালের নির্বাচনে সাতকানিয়া থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন।

তাছাড়া তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সাবেক সহ-সভাপতি। ১৭ বছরে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি ঢাকার একটি আদালত তাকে ৮ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং ২১ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড করেছেন। মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও তিনি এখনো রিহ্যাবের মতো প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে দেলোয়ার হোসেন সাজাপ্রাপ্ত হওয়া এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় কোনো মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে এমনটা জানেন না বলে জানান তিনি।

আওয়ামী শাসনামলে রিহ্যাব চট্টগ্রাম রিজিওনাল অফিসে দাসত্বের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। প্রায় একযুগ কোনো নির্বাচন ছাড়াই আওয়ামী লীগের লোকজন সংগঠনটি দখলে রেখেছিল। তবে ২০২৪ সালে একটি সাজানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও ঘুরে-ফিরে আওয়ামী লীগের লোকজন দখলে নেয় রিহ্যাবের পরিচালকের পদগুলো।

পতিত আওয়ামী সরকারের দোসররা আওয়ামী বিরোধী কোনো শক্তি বা ব্যক্তিকে ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ বা পরিবেশ দেয়নি। পুরো আওয়ামী লীগের লোকজন দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পরও তাদের একক রাজত্ব রয়ে গেছে রিহ্যাবে। অথচ এই সময়ে বেশিরভাগ সংগঠনের নেতৃত্ব ছেড়েছেন আওয়ামীপন্থিরা।

আরও পড়ুন :  সিএমপির ‘মানিলন্ডারিং’ তালিকায় ১৪৫ নেতা ও মন্ত্রী-এমপির নাম

শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের কেউ আত্নগোপনে, কেউবা পালিয়ে গেছেন বিদেশে এবং কয়েকজন ব্যবসায়ী এখনো জনসমক্ষে কথা বলছেন। এদের মধ্যে আওয়ামী মদদপুষ্ট রিহ্যাবের নেতৃত্বে থাকা আবাসন ব্যবসায়ীরা রঙ বদলিয়ে নানা কৌশলে বহাল থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এমনকি মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও রিহ্যাবের মতো একটি সংগঠনের পদ ধরে আছেন। রিহ্যাব চট্টগ্রামের অন্যান্য পরিচালকরাও আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।

এ বিষয়ে জানতে একাধিক বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া দেননি রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট মো. ওয়াহিদুজ্জামান। একই বিষয়ে কথা হলে রিহ্যাব পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. মনজুরুল ফরহাদ বলেন, সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়ে রিহ্যাবের রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান পদে থাকার সুযোগ নেই। কোনো ডকুমেন্ট থাকলে সেটা আমাকে দেন, আমি বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো। চট্টগ্রামে আওয়ামী দোসরের অবস্থান স¤পর্কে আমরা জানি। এগুলো নিয়ে অনেক কথাও হয়েছিল।

রিহ্যাবের একাধিক সদস্য জানান, জিডিপিতে আবাসন খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিপুল পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ এর সাথে স¤পৃক্ত ২৩৮টি লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রির জন্য এই খাত বড় ভূমিকা রাখে। বিগত আওয়ামী সরকারের উদাসীনতা ও অযোগ্যতার কারণে এই খাতে গভীর সমস্যা সৃষ্টি হয়। নতুন করে দেশ গড়ার এই ক্রান্তিলগ্নে স্বৈরাচারের দোসর এবং অযোগ্য নেতৃত্বে রিহ্যাবকে কুক্ষিগত করে রাখলে আবাসন খাত আরও গভীর সমস্যায় নিমজ্জিত হবে।

আরও পড়ুন :  সিএমপির ‘মানিলন্ডারিং’ তালিকায় ১৪৫ নেতা ও মন্ত্রী-এমপির নাম

শুধু আওয়ামী সংশ্লিষ্টতা নয়, হত্যা মামলার আসামি হয়েও গত এক বছরে বিভিন্ন সংস্থার সাথে অন্তত ২০টি বৈঠক করেছেন রিহ্যাব চট্টগ্রামের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন। এসব মিটিংয়ের ছবিসহ সংবাদও প্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। এর মধ্যে পুলিশ কমিশনার থেকে শুরু করে সিডিএ চেয়ারম্যান, চসিক মেয়রসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ অফিসে ছুটেছেন তিনি। স্বৈরাচারের দোসররা পলাতক থাকলেও দেলোয়ার হোসেন সবাইকে যেন বশে নিয়েছেন।

রিহ্যাব চট্টগ্রাম রিজিওনাল অফিসের সচিব বানার্ড বাবুল বলেন, রিজিওনাল কমিটির চেয়ারম্যান বা পরিচালক কারো বিরুদ্ধে কোনো মামলা থাকলে সেটা ওনাদের ব্যক্তিগত বিষয়। যদি কেউ সাজাপ্রাপ্ত হন তখনো আমার কিছু করার নেই। আমার কাজ অফিস পরিচালনা করা। ওনাদের ব্যাপারে অভিযোগ থাকলে সেটা সেন্ট্রাল কমিটির সাথে কথা বলতে হবে।

এর আগেও দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৯ সালে দেলোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী ছেমন আরা বেগমের বিরুদ্ধে ঢাকার রমনা মডেল থানায় পৃথক দুইটি মামলা দায়ের করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

তাছাড়া তার প্রতিষ্ঠান আরএফ বিল্ডার্সে ২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার এবং চুক্তি মতো ফ্ল্যাট বুঝে নিতে গিয়ে হামলা ও মামলার শিকার হয়েছেন এমন অভিযোগ তুলেছিলেন এক সাবেক সেনা কর্মকর্তা। ২০২১ সালের নভেম্বরে চাঁদাবাজির মামলায় কক্সবাজারে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। দুদকের মামলাও গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গিয়েছিলেন দেলোয়ার হোসেন।

ঈশান/মখ/মম

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page