
কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে গড়ে তোলেছে বিশাল সাম্রাজ্য। যার আওতায় এ পর্যন্ত ৫০০০ একরেরও বেশি জমি কব্জায় নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এর মধ্যে ১৬০ একরেরও বেশি জমি অধিগ্রহণের কোন টাকায় পায়নি মালিকরা। এমনকি এই ১৬০ একর জমি অধিগ্রহণ বা ক্রয়ের কোন তথ্যও নেই এস আলম গ্রুপের কাছে।
তবে তথ্যটি রয়েছে শুধু এই গ্রুপটির জমি ক্রয়ের দায়িত্বে থাকা এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের ভাগ্নে মোস্তাকিন বিল্লাহ আদিল ও তার ঘনিষ্ট সহচর কার্যকারক আনিস আহমেদের কাছে। আর জানেন ভুক্তভোগী জমির মালিকরা।
জমির মালিকরা জানান, জমি ক্রয়ের বিষয়ে অত্যন্ত সুচতুর ছিলেন আনিস আহমেদ। যা বুঝতেন না জমি ক্রয়ের ব্যবস্থাপক আদিলও। এ সুযোগে নানা রকম জালিয়াতি ও কারসাজি করে জমি অধিগ্রহণের কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন আনিস। তম্মধ্যে ১৬০ একর জমি অধিগ্রহণের নামে দখল দেখানো হলেও কোন টাকা পায়নি মালিকরা।
জুলাই অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর এস আলম গ্রুপ কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ পুরো প্রকল্প ছেড়ে দেশত্যাগ করলেও সেই সাম্রাজ্য লুটে খাচ্ছেন আনিস। অবশ্যই তার সাথে রয়েছে ১২ জনের একটি দালাল সিন্ডিকেটও। আবার লুটের অর্থ নিয়মিত পৌছে যাচ্ছ থানা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের কাছেও।
জমির মালিকদের তথ্যমতে, এস আলম গ্রুপ বাঁশখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াটের যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে তার জন্য ৫০-৬০ একর জমি লেগেছে। অথচ সরকার থেকে ১৭২৮.৯৭ একর খাস জমি ছাড়াও ৩৩০৩.১৭ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি ক্রয়ের অনুমোদন নেয় এস আলম গ্রুপ। যেখানে অধিগ্রহণের জন্য মাত্র ১৫০ পরিবারের বসতভিটা দেখানো হয়েছে। বাকি জমি দেখানো হয়েছে নাল হিসেবে। যা বড় ধরণের জালিয়াতি। অথচ মালিকানা সূত্রে এসব জমির উপর তিন হাজারেরও বেশি পরিবারের বসতভিটা রয়েছে।
এছাড়া মৌজা রেটে জমি ক্রয়ের জন্য সরকারি বাধ্যবাধকতা থাকলেও তার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি খরচ দেখিয়ে জমি ক্রয় দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে মৌজা রেটের অর্থও হাতে পায়নি জমির মাািলকরা। জমির প্রকৃত মালিক তিন হাজার পরিবারের ৮ হাজার ব্যক্তি হলেও অর্ধেক অর্থ পেয়েছেন এক হাজার জনের মতো মালিক। যাদের স্বাক্ষরে জমি ক্রয় দেখানো হয়েছে। আর জমির এসব মালিকদের সাথে গোপন চুক্তির মাধ্যমে প্রদত্ত টাকার অর্ধেক হাতিয়েছেন প্রকল্পের কার্যকারক আনিস আহমদ।
এর মধ্যে প্রায় দু‘শ পরিবারের ৮০০ ব্যক্তির ১৬০ একর জমি অধিগ্রহণের নামে এস আলমের কব্জায় নেওয়া হলেও সেই জমির অধিগ্রহণের কোন টাকা পায়নি জমির মাািলকরা। এস আলমের হিসাবেও নেই সেই জমি ক্রয় অধিগ্রহণের তথ্য। অথচ বিপুল পরিমাণ এই জমি কৃষি ও লবণ মাঠের নামে লীজ দিয়ে কার্যকারক আনিস প্রতিবছর হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
কৃষকরা জানান, এস আলমের গ্রুপের নামে জবরদখল করা প্রায় ১২০ একর জমি লবণ মাঠ হিসেবে, যা উপজেলার আলোকদিয়া, খাসেরঘোনা, চরবড়ঘোনা, সমিতিঘোনা আভাত্তেঘোনা এলাকায় অবস্থিত, আর ৪০ একর কৃষি জমি গন্ডামারা ও গোলাবিলে অবস্থিত। এর মধ্যে প্রতিএকর লবণ মাঠ দেড় লাখ টাকা এবং কৃষি জমি ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় লীজ দিয়ে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে আনিস।
এছাড়া এস আলম গ্রুপের কেউ প্রকল্প এলাকায় না থাকায় কার্যকারক আনিস অধিগ্রহণ করা জমিও লীজ দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। যার কিছুই জানে না এস আলম গ্রুপ। বরং এস আলম গ্রুপকে পুরো প্রকল্পের সম্পদ হেফাজতে রাখার কথা বলে অন্ধকারে রেখেছেন এই আনিস। আর এসব কাজ করতে আনিস বাঁশখালীতে ১২ জনের একটি দালাল সিন্ডিকেট তৈরী করেছেন। লুটের অর্থের অংশ চলে যাচ্ছে থানা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের কাছেও। ফলে রাষ্ট্রের লাখো কোটি টাকা পাচারের দায়ে পলাতক এস আলম গ্রুপের এসব সম্পদ আইনগতভাবে জব্দের বাইরেও থেকে যাচ্ছে।
এস আলম গ্রুপের এই দুরাবস্থার সুযোগ নিয়ে নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে এখন ধনকুবের এক সময়ের সহায়-সম্বলহীন আনিস। চট্টগ্রাম মহানগরীর বলিরহাট এলাকার পুলিশ বিটের নিকটে তিনি কোটি টাকায় জমি কিনে গড়েছেন একাধিক বহুতল ভবন, দোকান ও মার্কেট। কিনেছেন বহু প্লট ও ফ্ল্যাট। স্ত্রীর জন্য কিনেছেন শ শ ভরি স্বর্ণালংকার। স্বজনদের নামে একাধিক ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছেন কোটি-কোটি টাকা। নিজের নামে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে নিজেও করেছেন কোটি-কোটি টাকা লেনদেন।
অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত ধন-সম্পদের উপর যখন আনিস সুখের সাগরে ভাসছেন, ঠিক তখনি ফসলি জমি ও বসতভিটা হারিয়ে দু:খের সাগরে ভাসছেন প্রকল্প এলাকা বাঁশখালীর হাজারো মানুষ। যাদের অনেককে জালিয়াতির ফাঁদে জমি বিক্রয় করতে না চাওয়ায় এস আলম গ্রুপের নিরাপত্তা রক্ষিদের গুলিতে দিতে হয়েছে তাজা প্রাণও। আর এসব ঘটনার মূলে ছিলেন কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কার্যকারক আনিস আহমদ। তাকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হলে সব ধরণের অনিয়ম ও জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে আসবে। এমনকি এস আলম গ্রুপের দূর্নীতি তথ্যও ফাঁস হতে পারে।
স্থানীয়রা জানান, এস আলম গ্রুপের সবাই পালানোর পর বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ প্রকল্পের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে অনেক আগে। কিন্তু আনিস আহমেদ বেতন না পেয়েও এখনও নিয়মিত অফিস করে যাচ্ছেন প্রকল্প এলাকায়। এমনিক রাতে অফিস কোয়াটারে অবস্থান করে বিভিন্ন খাত থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারও বাঁশখালীতে অবস্থান করে এস আলম গ্রুপের বিশাল সাম্রাজ্য লীজ দিয়ে লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। আর এতে মুখ খুললে জেলখানায় পাঠানোর হুমকি দিচ্ছেন জমির মালিকদের।
এ বিষয়ে জানতে প্রকল্পের জমি ক্রয় বিভাগের ব্যবস্থাপক ও এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের ভাগ্নে মোস্তাকিন বিল্লাহ আদিলের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। এমনকি এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা পলাতক থাকায় তাদের কারও সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এছাড়া এ বিষয়ে জানতে আনিস আহমদের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। মেসেজ অপশনে গিয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনরম প্রত্যুত্তর তিনি দেননি। খবর নিয়ে জানা গেছে, আনিস আহমেদের অনিয়ম-দূর্নীতির বিষয়ে গত গত ১ মার্চ দৈনিক ঈশানে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশের পর তার ব্যবহৃত নাম্বারটি মুঠোফোন থেকে খুলে রাখা হয়েছে।
তবে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশের আগে মুঠোফোনে কথা বলার সময় আনিস আহমদ দৈনিক ঈশানকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সব মিথ্যা। জমি কেনার সময় খুশি হয়ে যে যা দিয়েছে, আমি তা নিয়েছি। কারো কাছ থেকে কারসাজি বা জোর করে টাকা আদায় করিনি। খুশি হয়ে কে কত দিয়েছে জানতে চাইলে আনিস আহমদ বলেন, ধরেন ১০/২০ হাজার টাকা, এরকম।
দোকান-মার্কেটসহ বহুতল ভবন নির্মাণ, কোটি টাকার জমি, প্লট-ফ্ল্যাট, স্ত্রীর জন্য শ শ ভরি স্বর্ণালঙ্কার গড়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আনিস আহমদ বলেন, ভাই এভাবে বললে কিভাবে হয়? আমার দিকে তো একটু দেখতে হবে। বাঁশখালীর অনেক সাংবাদিকের সাথে তো আমার সম্পর্ক রয়েছে। এক সাংবাদিকের আমি অনেক বড় উপকার করেছি।
নাম পরিচয় জানিয়ে ওই সাংবাদিককে আমি চিনি কিনা জানতে চান আনিস। আমি তাকে বলি আপনাকে একটা ফোন করতে। এ কথা বলে তিনি মুঠোফোনের সংযোগ কেটে দেন। পরে ওই সাংবাদিকের মাধ্যমে একটু দেখা করার কথা বলেন আনিস আহমদ। এক পর্যায়ে নগরীর এক হোটেল দেখা হলে তিনি নিউজটি বন্ধ করতে কি করতে হবে জানতে চান। এ সময় তিনি মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদানের প্রস্তাব দেন।
(বি:দ্র: এস আলম গ্রুপের কার্যকারক আনিস আহমদের নানা অনিয়ম-দূর্নীতির দ্বিতীয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। তৃতীয় প্রতিবেদন প্রকাশ হবে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কোটি টাকার যন্ত্রাংশ ও স্ক্র্যাপ পাচার নিয়ে। প্রিয় পাঠকরা চোখ রাখুন দৈনিক ঈশানে)
এ সংক্রান্ত খবর আরও পড়ুন: