বৃহস্পতিবার- ১৫ মে, ২০২৫

দুর্ভিক্ষ দেখে ক্ষুদ্র ঋণ চালু করি, নোবেল পাবো ভাবিনি

চবির ৫ম সমাবর্তনে ড. ইউনুস

দুর্ভিক্ষ দেখে ক্ষুদ্র ঋণ চালু করি, নোবেল পাবো ভাবিনি

ক্ষুদ্র ঋণব্যবস্থার প্রবর্তন এবং এর জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর ৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সারাদেশে তখন হাহাকার চলছে। সেই দুর্ভিক্ষ দেখে মানুষের জন্য কিছু করার চিন্তা আসে। এই চিন্তা থেকে ক্ষুদ্র ঋণ চালু করি। নোবেল পুরুস্কার পাবো তা কখনও ভাবিনি।

বুধবার (১৪ মে) দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।

দুটি নোবেল পুরস্কার পাবার জন্য চবি গর্ববোধ করতে পারে উল্লেখ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তন শিক্ষক ড. ইউনূস বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যখন নিজের পরিচয় দেয়, হয়তো নোবেলের জন্য গৌরববোধ করে। কিন্তু চবির গৌরববোধ করার কারণ দুইটা আছে। পুরো কর্মসূচি, যার জন্য নোবেল পুরস্কার, এর গোড়াপত্তন হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটি তো আমি ব্যক্তিগতভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। তারপর যে গ্রামীণ ব্যাংক সৃষ্টি হল, এই ব্যাংকের গোড়াতেও চবি।

গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে এটা পরিষ্কার লেখা আছে যে, এটা কোথা থেকে আসল? ব্যাংকের জন্ম হয়েছে চবিতে অর্থনীতি বিভাগে, এটা ¯পষ্ট উল্লেখ আছে। এই ব্যাংকও নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। কাজেই দুটি নোবেল পুরস্কারের বিষয় চবি তার ছাত্রছাত্রীদের এর ইতিহাস জানাতে পারে। তাহলে ছাত্রছাত্রীরা ঠিক করবে যে তারা কী ধরনের ভবিষ্যত গড়তে চায়। -বলেন ড, ইউনুস।

শিক্ষা-গবেষণায় নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখার তাগিদ দিয়ে সমাবর্তীদের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা যে ধরনের বিশ্ব গড়তে চাই, সেই বিশ্ব গড়ার ক্ষমতা আমাদের আছে, সকল মানুষেরই আছে। কিন্তু আমরা গৎবাঁধা পথে চলে যাই বলে নতুন পৃথিবীর কথা চিন্তা করি না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যেন সবসময় এটা স্মরণ রেখেই তার পাঠদান কর্মসূচি, তার গবেষণা শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য চালু রাখে যে আমরা শুধু খন্ডিত বিষয়ের গবেষণা করার জন্য নিয়োজিত নই। আমরা প্রত্যেকটি বিষয়ের পেছনে একটিই উদ্দেশ্য, সমস্ত বিশ্বকে আমাদের মনের মতো করে সাজানোর জন্য, মনের মতো করে বানানোর জন্য। আমাদের যদি সেই লক্ষ্য না থাকে, তাহলে গন্তব্যবিহীন গবেষণা, গন্তব্যবিহীন শিক্ষায় পরিণত হবে।

তিনি বলেন, এ পৃথিবীর ভবিষ্যত আমাদের প্রত্যেকের হাতে। আমরা যেভাবে বিশ্বকে গড়তে চাই সেভাবেই বিশ্ব গড়তে পারি। আমি যেভাবে বলেছি সেভাবে গড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি আমার কথাটা বলে যাচ্ছি। অন্যরা তাদেরটা বলবে। কিন্তু নিজের মনের একটা স্বপ্ন থাকতে হবে এটাই আমার আবেদন। আমি কী ধরনের বিশ্ব চাই, কী ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চাই, কী ধরনের সমাজ চাই, কী ধরনের দেশ চাই- সবকিছু নিয়ে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে একটা স্বপ্ন থাকতে হবে। কিন্তু স্বপ্ন না দেখে গর্তের মধ্যে ঢুকে গেলাম, যা আছে মেনে নিলাম, তাহলে কিছুই পালটাবে না, কিছুই পরিবর্তন হবে না।

অর্থনীতি হতে মানুষের জন্য, ব্যবসাকেন্দ্রিক নয় এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমাদের মানুষের অর্থনীতি গড়তে হবে। আমাদের অর্থনীতি যদি শুরু করতে হয়, মানুষকে দিয়ে শুরু করতে হবে, ব্যবসাকে দিয়ে নয়। অথচ আমরা ব্যবসাকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে তুললাম, এটা আত্নঘাতী সভ্যতা, এটা টিকবে না। যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি লেখাপড়া শুরু করলাম, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ই আমাকে বলল- এই বিদ্যায় পৃথিবী ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, এর থেকে রেহাই পাবার কোনো উপায় নেই।

সমাবর্তীদের উদ্দেশ্যে নোবেলজয়ী ইউনূস বলেন, সমাবর্তন একজন মানুষের জীবনে একটি মস্তবড় ঘটনা। সনদ নেবে, ছবিটি সংরক্ষণ করবে, সেটা সবাইকে দেখায়, সেই বিশেষ দিনটি আজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টা কত তাড়াতাড়ি চলে যায়, কেটে যায় বোঝা যায় না। যখন শেষ হয়ে যায়, তখন মনে বড় কষ্ট লাগে। জীবনের একটা বড় অধ্যায় শেষ হল, নতুন অধ্যায়ের শুরু।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ইয়াহইয়া আখতারের সভাপতিত্বে এতে শিক্ষা উপদেষ্টা সি. আর আবরার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান এস এম ফয়েজ বক্তব্য দেন।

সমাবর্তনের সভাপতি ও চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার বলেন, আমরা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে ডি লিট ডিগৃ প্রদান করেছি। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। মুহাম্মদ ইউনূসের জীবনের অর্জনগুলোর সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স¤পর্ক রয়েছে। আজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। প্রধান অতিথি এবং শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে দিনটি পূর্ণতা পেয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা তেমন হচ্ছে না। মনে রাখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, এটি শুধু রাজনীতির জায়গা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ রাজনৈতিক নেতা তৈরি করা নয়, যোগ্য গ্রাজুয়েট তৈরি করা। আমাদের অনেক শিক্ষক অ্যাকাডেমিক কাজে গুরুত্ব না দিয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতির সম্মুখীন হন।

সমাবর্তন শুরুর প্রাক্কালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগৃ দেয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ এবং বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদানের জন্য নোবেল জয়ী অধ্যাপককে এই ডিগৃ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে ডি লিট ডিগৃ তুলে দেন উপাচার্য ড. ইয়াহইয়া আখতার। এ সময় চবি উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান এবং উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) মো. কামাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর বুধবার প্রথমবার চট্টগ্রাম সফরে যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তিনি বেশ কিছু কর্মসূচিতে অংশ নেন। সকাল সোয়া ৯টায় চট্টগ্রাম শাহ আমাত আন্তর্জাতিক বিমানর বন্দরে নেমেই তিনি চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে যান। সেখানে এক মতিবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন তিনি। এরপর চটগ্রাম সার্কিট হাউজে এসে জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে আরও এক মতিবিনময় সভায় যোগ দেন।

এরপর চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশনের জমির দলিল হস্তান্তর অনুষ্ঠানে অংশ নেন তিনি। পরে সেখান থেকে চট্টগ্রাম-কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতুর নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্তরের ফলক উম্মোচন করেন। সেখান থেকে যোগ দেন চবির ৫ম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠান শেষে তিনি হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের বাথুয়া গ্রামে পৈতৃক বাড়ি পরিদর্শনে যান প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে তিনি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, এলাকাবাসীর সঙ্গে সময় কাটাবেন। সন্ধ্যায় বিমানে চট্টগ্রাম ত্যাগ করার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page