
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল এলাকার (সিইপিজেড) হেমপেল-রী ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি বিডি লিমিটেড নামে একটি গার্মেন্টস কারখানা থেকে প্রায় কোটি টাকার শুল্কবিহীন কাপড় পাচারে উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর চোরচক্রের নাম। যাদের নেতৃত্বে রয়েছেন সালাউদ্দিন ও ইকবাল চৌধুরী।
কাপড় পাচারে জড়িত কাভার্ডভ্যান চালকের জবানবন্দিতে এই তথ্য উঠে এসেছে বলে জানান কাস্টমস কর্মকর্তারা। যদিও বিষয়টি গোপন করার ছলচাতুরি করছেন বেপজার গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। এমনকি হেমপেল-রী কর্তৃপক্ষও বিষয়টি বেপজা ও কাস্টমন কর্মকর্তার তদন্তের কথা বলে এড়িয়ে গেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেমপেল-রী‘র ম্যানুফ্যাকচারিং কো¤পানি বিডি লিমিটেড এর এডমিন তানজিরুল ইসলাম বলেন, গত ৫ মে দিবাগত রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে সিইপিজেড গেইটে নিরাপত্তা কর্মীরা, কাপড় বহন করা একটি কাভার্ডভ্যান (ঢাকা মেট্রো ১৩.১৬৪৩) সহ ড্রাইভারকে আটক করে। বিষয়টি বেপজা কর্তৃপক্ষ তদন্ত করছেন। এছাড়া কাস্টমস কর্তৃপক্ষও বিষয়টি তদন্ত করছেন। এ অবস্থায় আমরা কোন কথা বলতে চাচ্ছি না। তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হলে তো পেয়ে যাবেন এই ঘটনায় জড়িত চোর কারা। এখন আমি কিছুই বলতে পারব না।
আপনার কারখানার কাপড় চুরি হয়েছে- এ বিষয়ে সবার আগে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ বা মামলা দায়ের করার কথা, কিন্তু সেটা কতটুকু করলেন-প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, না আমরা মামলা করিনি। কারণ চোরাই কাপড় জব্দ করেছে বেপজা। মামলা করলে বেপজা করবে, আমরা কেন করব?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেপজার জিএম আব্দুস সোবহান বলেন, কাপড়, কাভার্ডভ্যান ও চালক জব্দ বা আটক করার ক্ষমতা বেপজার নেই। এসব ঘটনায় আমরা মামলাও করতে পারি না। আমাদের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিভাগ থেকে এ ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন একজন মেজর। আর কাপড়সহ আটক কাভার্ডভ্যান ও চালককে আমরা কাস্টমসে হস্তান্তর করেছি। যা করার কাস্টমস করবে।
কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তা মিয়া মো. নাজমুল হক বলেন, কাপড়ের শুল্কই আমাদের দেখার বিষয়। কাপড় পাচারের বিষয়ে ইতোমধ্যে আমরা হেমপেল-রী ম্যানুফেকচার লিমিটেড কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অলরেডি একটি মামলা করেছি। মামলায় বিনাশুল্কের ৯৭ লাখ টাকার কাপড় জব্দের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সরকারি শুল্ক ৮৭ লাখ টাকা ফাঁকির বিষয়টি আনা হয়েছে। এছাড়া আরও ৮৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। হেমপেল কর্তৃপক্ষ চাইলে শুল্ক ও জরিমানা পরিশোধ করে কাপড়গুলো ছাড়িয়ে নিতে পারবেন।
তিনি বলেন, কাভার্ডভ্যান বেপজা কর্তৃপক্ষের অধীনে আছে। ড্রাইভারও তাদের অধীনে থাকার কথা। কিন্তু তিনি কোথায় সেটা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানে না। বেপজা কর্তৃপক্ষ চাইলে কাভার্ডভ্যান ও চালকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। কিন্তু তারা কেন মামলা করেননি সে বিষয়ে জানা নেই। যতদুর জেনেছি, ড্রাইভারকেও ছেড়ে দিয়েছে তারা।
এক প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাস্টমসের আরেক কর্মকর্তা বলেন, আটকের পর কাভার্ডভ্যান চালক একটা জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি সালাউদ্দিন ও ইকবালসহ সংঘবন্ধ চোরচক্র ও জড়িত কয়েকজনের কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে ইকবাল ঝুটের ব্যবসা করলেও সালাউদ্দিন ওই কারখানায় লাঞ্চ সরবরাহ করেন। এ সুবাধে সংশ্লিষ্ট কারখানার কর্মকর্তাদের সাথে চোরচক্রের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এছাড়া এই চুরির সাথে বেপজার নিরাপত্তাকর্মীরাও জড়িত থাকতে পারেন।
বেপজার তথ্যমতে, চোরাইকৃত গার্মেন্টস কাপড় সিইপিজেড ৩নং রোড়ে অবস্থিত হেমপল-রী ম্যানুফ্যাকচারিং কো¤পানি বিডি লিমিটেড এর। যেগুলো গোপনে পাচার হওয়ার খবর পেয়ে জব্দ করা হয়।
হেমপেল-রী‘র জেনারেল ম্যানেজার মুহা. মহিউদ্দিনের দাবি, পণ্যগুলো বাইয়ারের কাছে সরবরাহের জন্য গত ৫ মে কাভার্ডভ্যানে লোড করা হয়েছিল। যেগুলো অসাধু চোরচক্র বাইরে পাচার করে দিতে চেয়েছিল। তবে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ঘটনাটি এখন দুটি সংস্থা থেকে তদন্তাধীন। আমাদের আভ্যন্তরীণভাবেও তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষে নিশ্চয় বের হবে এ ঘটনার সাথে জড়িত কে বা কারা। এ কথা বলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তবে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সালাউদ্দিন আমাদের লাঞ্চ সাপ্লাইয়ার। এ ঘটনায় সে জড়িত নয় আমি সেটা বলছি না, জড়িত থাকলে তদন্তে অবশ্যই বেরিয়ে আসবে।
কিন্তু কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দাবি, শুল্কমুক্ত পণ্যের আওতায় বিদেশ থেকে আনা এসব কাপড় সিইপিজেডের বিভিন্ন গার্মেন্টস থেকে দীর্ঘদিন ধরে পাচার করে বাইরে এনে বিক্রি করে যাচ্ছে চোরচক্র। নানা পথে নানা পন্থায় এসব পণ্য চট্টগ্রাম এবং ঢাকার বড় বড় কাপড়ের বাজারে বিক্রি হয়।
চট্টগ্রামের টেরিবাজার এবং ঢাকার ইসলামপুরের কাপড়ের বাজারের বড় অংশ দখল করে রয়েছে সিইপিজেডের কাপড়। নগরীর আগ্রাবাদ এবং জিইসি মোড়ের ফুটপাতের জুতার বিশাল বাজার ছাড়াও নগরীর অভিজাত বিপনী বিতানগুলোতে থরে থরে শোভা পাচ্ছে ইপিজেডের জুতাসহ নানা পণ্য।
অথচ প্রচলিত শুল্কহারের পুরোটাই পরিশোধসহ বিশেষ কিছু শর্তে ইপিজেড এ উৎপাদিত পণ্যের খুব সামান্য স্থানীয় বাজারে বিক্রির সুযোগ রয়েছে। শুল্ক পরিশোধ ব্যতীত ইপিজেড থেকে কোন পণ্যই বাইরে আসার সুযোগ নেই।
সূত্র জানায়, হেমপেল-রী ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বিডি লিমিটেড ফ্যাক্টরির এই চুরির ঘটনা শেষ নয়, বহু ঘটনার একটি। সালাউদ্দিন ও ইকবালের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ চোরচক্র দীর্ঘদিন ধরে এই কাজে সক্রিয়। সালাউদ্দিন স্থানীয় ৩৮নম্বর ওয়ার্ড কলসি দিঘীরপাড় মৃত মোহাম্মদ ইসলামের পুত্র। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইপিজেডের কাপড় পাচার করে বেশ কয়েকবার খবরের শিরোনাম হলেও অদৃশ্য কারণে অধরাই থেকে যাই।
সিইপিজেডের বিভিন্ন কারখানায় কর্মরতরা জানান, সিইপিজেড থেকে প্রতিদিনই ঝুট বের করা হয়। কোন না কোন কারখানার ঝুটের চালান বের করে বাইরে আনা হয়। কারখানা থেকে ঝুট এবং ময়লা বের করার কথা বলে ভিতরে পণ্য ঢুকিয়ে পাচার করা হয়। বাইরে ওয়াশিংয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেও পাচার হয়। প্রতিদিনই কাভার্ডভ্যান ভর্তি করে কাপড় নিয়ে আসা হয়। এসব দেখেও দেখে না সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে দুয়েকটি চালান ধরা পড়লেও অধিকাংশ চালানই গন্তব্যে পৌঁছে যায়। ঝুটের আড়ালে বের করে আনা কাপড় নামসর্বস্ব কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও ঢাকায় পাচার করা হয়। বিভিন্ন যানবাহন চেক করা হলেও কুরিয়ারের গাড়িগুলো নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে যায়।
চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে অবৈধপথে পণ্য পাচারকারী চক্রের মূল হোতা হিসেবে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় পণ্য পাচারসহ নানা কারণে থানায় মামলা হয়েছে। তবে চক্রের মূল হোতারা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এর মূল কারণ কারখানার মালিক, কর্মকর্তা, কাস্টমস, বেপজা এবং পুলিশের একাধিক অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীও পণ্য পাচার নেটওয়ার্কের সক্রিয় সহযোগী। বিশাল এই চক্র অত্যন্ত শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী। এই চক্রের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া কঠিন। তাই ইচ্ছে থাকলেও অনেক কর্মকর্তাই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননা।
এ ব্যাপারে জানতে অভিযুক্ত ইকবাল চৌধুরীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসবের সাথে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। কাভার্ডভ্যান ড্রাইভার জবানবন্দিতে কোন ঝুট ব্যবসায়ীর কথা বলেননি। এরপরও আপনি তথ্য পেলে লিখেন। আমার তো কিছুই করার নেই।
তবে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন মুঠোফোনে বলেন, এ ঘটনায় আমি জড়িত নই। যা পারেন লিখেন। ফাসিবাদের দোসররা আমাকে জড়াচ্ছে। ফ্যাসিবাদের দোসর কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, জিয়াউল হক সুমন, হুমায়ুন, রবিন, আনোয়ার এরা সবাই। এরাই চোরচক্রের মূল হোতা। আপনিও তো একসময় তাদের সাথে ছিলেন, এমন প্রশ্ন করা তিনি বলেন, গত ১৫ বছর আমি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমনের সাথে ছিলাম, এটার ছবি দেখাবেন এই আর কি? কিন্তু আমি কখনোই আওয়ামী লীগের দোসর ছিলাম না। আচ্ছা যাই হোক, আপনি আমার সাথে দেখা করেন। দেখা করতে অনিহা প্রকাশ করলে বলেন, আচ্ছা বিকাশ নাম্বার দেন।