সোমবার- ১৮ আগস্ট, ২০২৫

চট্টগ্রামে জ্বলে উঠে দাবানল, হামলা চালায় আ‘লীগ

চট্টগ্রামে জ্বলে উঠে দাবানল, হামলা চালায় আ‘লীগ

০২৪ সালের আগস্টের শুরু থেকেই উত্তাল ছিল বন্দরনগরী চট্টগ্রামের রাজপথ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে জ্বলে উঠে দাবানল। ষোলশহর-মুরাদপুর-বহদ্দারহাট থেকে নিউমার্কেট মোড় পর্যন্ত হয়ে ওঠে হাজারো ছাত্র-জনতার ঠিকানা। মিছিলে-মিছিলে সয়লাব থাকে নগরী।

আন্দোলনের শুরু থেকে আক্রমণাত্নক হয়ে থাকা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও দফায় দফায় হামলা চালাতে থাকে ছাত্র-জনতার মিছিলে। এতে হাসপাতালে বাড়তে থাকে হতাহত ছাত্র-জনতার সংখ্যা। সেদিন ছিল ৪ আগস্ট আন্দোলনের ৩৫তম দিন।

তবে সন্ধ্যার পর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বুঝতে পারে সরকার পতন অনিবার্য। ফলে পতনের অপেক্ষার সাথে অনেকেই গোছাতে থাকে তল্পিতল্পা। কেউ কেউ আবার মারাত্নকভাবে মারমুখী হয়ে ওঠে। কারণ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে আন্দোলন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছিল আগেরদিনই।

সেদিন নিউমার্কেট মোড়ে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর শেষবারের মতো হামলে পড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কিন্তু সেখানে উপস্থিত সেনাসদস্যরা সেদিন আর নীরব থাকতে দেখা যায়নি। তারাই সেই আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। হামলা থেকে বাঁচার পর আন্দোলনকারীরা সেদিন সেনাসদস্যদের জড়িয়ে ধরে উল্লাস প্রকাশ করেন। এ ঘটনা পুরো আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

৪ আগস্ট বেলা ১২টার দিকে নিউমার্কেট মোড় থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে আন্দোলনকারীরা রিয়াজউদ্দিন বাজার, তিনপুলের মাথা ও স্টেশন রোড এলাকায় বিভিন্ন মার্কেটে ঢুকে পড়ে। আওয়ামী লীগের সশস্ত্র নেতাকর্মীদের আক্রমণের মুখে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ প্রায় পাঁচ ঘন্টা সেখানে অবরুদ্ধ ছিলেন। থেমে থেমে তাদের মধ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ চলছিল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলিও ছুঁড়ে।

বিকেল ৫টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি সাজোয়া যান নগরীর আমতল হয়ে নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছিল। সেই সাজোয়া যান দেখে অলিগলি থেকে কিছু আন্দোলনকারী ¯ে¬াগান দিতে দিতে বেরিয়ে আসেন। সাজোয়া যান এগিয়ে যেতেই সেনাসদস্যদের বহনকারী আরও কয়েকটি গাড়ি ওই এলাকায় আসে।

তখন রিয়াজউদ্দিন বাজার, তামাকমুন্ডি লেইন, জলসা মার্কেট, গোলাম রসুল মার্কেট, স্টেশন রোডের বিভিন্ন মার্কেট থেকে দলে দলে আন্দোলনকারীরা বেরিয়ে আসেন। তারা সেনাসদস্যদের উপস্থিতিতে স্লোগান দিতে দিতে নিউমার্কেট এলাকায় পৌঁছান।

এর মধ্যে তিনপুলের মাথা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে যেতে থাকলে সেনাসদস্যদের প্রতিরোধ করতে দেখা যায়। সেনাসদস্যদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পিছু হটে। এ অবস্থায় আবারও নিউমার্কেট মোড় আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আবারও আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও ককটেল ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু নিউমার্কেট এলাকায় সেনাসদস্যরা আক্রমণকারীদের প্রতিহত করেন। এতে নিউমার্কেটসহ আশপাশের এলাকা ছেড়ে যায় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা। আন্দোলনকারীদের সেনাসদস্যদের সাজোয়া যান ঘিরে উল্লাস করে স্লোগান দিতে দেখা যায়।

এর আগে নিউমার্কেট থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে একদল আন্দোলনকারী ওয়াসার মোড়ে এসে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় আলমাস মোড়ের দিক থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গিয়ে তাদের ওপর হামলার চেষ্টা করলে সেনাসদস্যরা প্রতিরোধ করেন। দিনভর সংঘাতে শতাধিক মানুষ আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরী বিভাগের তথ্যমতে, সেদিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের নিয়ে আসা শুরু হয়। কেউ মাথায়, কেউ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন। কাউকে আনা হয় অজ্ঞান অবস্থায়।

হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগে এফসিপিএস কোর্সে অধ্যয়নরত চিকিৎসক মো. মিজানুর রহমান ওই দিন সকাল থেকে চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে ছিলেন। তিনি বলেন, আহত ব্যক্তিরা হাসপাতালের ওসেক (ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার) হয়ে ক্যাজুয়ালটিতে চলে আসেন। একের পর এক আহত ব্যক্তি আসতে থাকেন। প্রাথমিক কাজ ছিল তাঁদের ইনজুরি শনাক্ত করে সেই অনুযায়ী সেবা দেওয়া। সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ডের অস্ত্রোপচার কক্ষে তাঁদের ঢোকানো হচ্ছিল। যাদের ফ্র্যাকচার ছিল, তাদের প্লাস্টার দেওয়া, কাউকে সেলাই দেওয়া, আবার কারও জরুরি অস্ত্রোপচার চলছিল সমানতালে।

মিজানুর রহমান বলেন, রোগীর চাহিদা অনুযায়ী সেখান থেকে অর্থোপেডিক, নিউরো সার্জারি ও জেনারেল সার্জারি বিভাগেও পাঠানো হচ্ছিল। মেঝেতেও ছিলেন রোগী। রোগীর পাশাপাশি তাদের স্বজন ও বন্ধুবান্ধবে ভর্তি ছিল পুরো হাসপাতাল। সবাই আহত ব্যক্তিদের সেবায় এগিয়ে আসছিলেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, সেদিন আহত প্রায় ২০০ জনকে সেবা দেওয়া হয়। তবে তাদের অনেকের তথ্য নিবন্ধনও করা যায়নি। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন অনেকে। যাঁরা বুলেটে আহত হন; কিংবা হাত-পা ভেঙেছে, তাঁদের দীর্ঘ চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মাথায় আঘাতপ্রাপ্তদেরও হাসপাতালে দীর্ঘদিন থাকতে হয়।

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে মিজানুর রহমান বলেন, এ পরিস্থিতি ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত। তাই এত রোগীর কারণে সরকারিভাবে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যান্ডেজ-ওষুধপত্র দেওয়া অসম্ভব ছিল। ফলে আমরা চিকিৎসকেরা তাৎক্ষণিকভাবে বাইরে থেকে ওষুধপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী কিনে আনতে আহত ব্যক্তিদের সহযোগিতা করি; কিন্তু বেলা চারটার দিকে আওয়ামী লীগের বাহিনী এসে আমাদের ওয়ার্ড থেকে বের করে দেয়।

দিনটি নিদারুণ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয় থেকে শুরু করে সব কর্মী আহত ব্যক্তিদের সেবা দিতে সচেষ্ট ছিলেন। সবার সহযোগিতায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

মিজানুর রহমান আরও বলেন, সেদিন ক্যাজুয়ালটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ঋভুরাজ চক্রবর্তী, সহকর্মী দিদারুল আলম, মিনহাজুল ইসলাম, রিয়াজুল, মইনসহ হাসপাতালে কর্মরত অনেক চিকিৎসক আহত ব্যক্তিদের সেবায় এগিয়ে এসেছিলেন।

সন্ধ্যার পর নিউমার্কেট এলাকা থেকে আন্দোলনকারীরা সরে যান। এরপর তারা ভাগ হয়ে নগরীর বহদ্দারহাট ও আগ্রাবাদে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে বিক্ষোভের মধ্যে হামলার ঘটনা ঘটে। এদিন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, বাঁশখালী এবং পটিয়ায় বিক্ষোভকারী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রামে গণমিছিল করবে জামায়াত
৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে গণমিছিলের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ থেকে গণমিছিলটি শুরু হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগরীর ভারপ্রাপ্ত আমির মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম।

সোমবার (৪ আগস্ট) চট্টগ্রাম নগরীর একটি বিশেষ দায়িত্বশীল বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে এই গণমিছিল সফল করার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, আয়োজিত গণমিছিল সফল করতে ছাত্র, জনতা, শ্রমিকসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নিতে হবে।

নজরুল ইসলাম দাবি করেন, ২০২৪ সালের এদিনে সরকারবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার পতনের মুখে পড়ে।

তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছরের দুঃশাসনে দেশে খুন, গুম, দুর্নীতি, লুটপাট আর দমন-পীড়ন চালিয়েছে সরকার। হাজারো মানুষ আহত, পঙ্গু ও নিহত হয়েছে। মানুষ রাজপথে নেমে এসে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ রুখে দিয়েছিল।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ নুরুল আমিন, সহকারী সেক্রেটারি মোহাম্মদ উল্লাহ, ফয়সাল মুহাম্মদ ইউনুস, শ্রমিক নেতা লুৎফুর রহমানসহ নগর কর্মপরিষদের নেতারা।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page