
# চালের দামের উত্থান-পতন সবই তার হাতে
# পাহাড়তলীতে ১০ আড়তের মালিক তিনি একাই
# ভয়ে কথা বলেন না অন্য চালের ব্যবসায়ীরা
চালের দাম এখন এক, হঠাৎ বেড়ে বা কমে হয় আরেক। এসবের পেছনে শুধু বেশি মুনাফা নয়, আছে অন্যরকম রাজনীতিও। সেটা হচ্ছে অন্য চাল ব্যবসায়ীদের পুঁজি খুঁইয়ে দেওয়া। যাতে পুরো চালের বাজার থাকে তাঁর হাতে। সে লক্ষ্য অনেকাংশে পূরণও হয়েছে।
একে একে চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলী চালের পাইকারি বাজারে অন্তত ৩০জন ব্যবসায়ী পুঁজি খুঁইয়ে এখন রাস্তার ভিখারি। আর তাদের ব্যবসা এখন তাঁর দখলে। ন্যূনতম মুল্যে পুঁজি হারানো ব্যবসায়ীদের দোকান কিনে নিয়েছেন তিনি। এভাবে শুধুমাত্র পাহাড়তলী বাজারেই ১৫টি দোকানের মালিক তিনি।
তিনি হলেন নোয়াখালীর সাহাব উদ্দিন। যাকে সবাই এক নামে চিনেন চট্টগ্রামের চালের বাজারের মাফিয়া ডন হিসেবে। তার মূল ব্যবসার আড়ত হচ্ছে খাজা ভান্ডার. আল্লাহর দান, দরবার ষ্টোরসহ আরও কয়েকটি আড়ত। যেখানে বসে চালের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।
এছাড়া গত কিছুদিন আগেও তিনি প্রায় দেড় কোটি টাকায় কিনেছেন শাহীন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি চালের আড়ত। এর আগে কিনেছেন আরাফাত স্টোর নামে আরেকটি আড়ত। যারা সাহাব উদ্দিনের কারসাজিতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারেনি। আর এসব কারসাজি করার অস্ত্র হচ্ছে সরকারি গুদাম ও বেসরকারি মিলের চাল চুরি। যা দিয়ে চালের দামে তিনি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন বলে মত দেন চালের আড়তদাররা।
গত রবিবার (২৪ আগস্ট) সরেজমিনে পরিদর্শনের সময় পাহাড়তলী বাজারের চালের একাধিক আড়তদারের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। যারা শুরুতে সাহাব উদ্দিনের নাম শুনেই চোখ কপাালে তুলে জগতের বিস্ময় প্রকাশ করেন।
এর মধ্যে অ.. ট্রেডার্স নামে একটি আড়তের একজন চাল বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাহাব উদ্দিন দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চট্টগ্রামে চালের ব্যবসা করে আসছেন। তিনি এখন সবচেয়ে পুরোনো চাল ব্যবসায়ীদের একজন। তার বাড়ি নোয়াখালী এলাকায়।
কিন্তু তিনি চট্টগ্রামে অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন, শুধুমাত্র এই চালের ব্যবসা করেই। অথচ তার সাথে একই সময়ে অনেক পূরোনো চাল ব্যবসায়ী আছেন যারা সম্পদের দিক থেকে তার ধারে কাছেও যেতে পারেননি। এর মূল রহস্য সরকারি গুদামের চাল চুরি।
দেশের উত্তরাঞ্চল থেকেও আমদানি করা চালভর্তি ট্রাক চুরির সাথে জড়িত সে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তার দুর্ধর্ষ চোর চক্র রয়েছে। একইভাবে সরকারি গুদাম থেকেও সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে চাল চুরি করে। পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সে এসব অপকর্ম করে। আর বাজারে যখন যেদাম ইচ্ছা করে, তখন সে দামে চাল বিক্রি করতে পারে। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ধরাশায়ী হয়। লোকসান দিয়ে পথের ফখির হয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাহাড়তলি বাজার গলির আরেক চালের আড়তদার বলেন, বাজারে চালের দাম সুযোগ বুঝে বাড়িয়ে দেয় সাহাব উদ্দিন। এতে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় সে। আবার হঠাৎ করে চালের দাম কমিয়েও দেয়। এতে অন্য চাল ব্যবসায়ীদের লোকসান হলেও তার হয় না। কারণ সরকারি গুদামের চোরাই চাল তিনি অনেক কম দামে কিনেন। আর পরিবহনের সময় চুরি করা চালের ক্ষেত্রে স্থানীয় থানা ও হাইওেয়ে পুলিশকে যে টাকা দেয় তার সেই চাল কেনার দাম বাজার দরের অর্ধেকও হয় না। এ কারণে তিনি দাম বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিলেও লোকসানের মুখে পড়ে না।
কিন্তু তার এই কারসাজিতে পড়ে পাহাড়তলী চালের বাজারের শত শত ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছে। যাদের অনেকের চালের আড়ত তিনি কিনে নিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি দেড় কোটি টাকায় শাহীন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি আড়ত কিনে নিয়েছেন। এর আগে দুই কোটি টাকায় আরাফাত স্টোর নামে একটি আড়ত কিনেছেন। এভাবে তিনি শুধুমাত্র পাহাড়তলি চালের বাজারে অন্তত ১৫টি দোকানের মালিক। যেখানে দেড়শ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। চালের ব্যবসায় এতবড় অঙ্কের বিনিয়োগ পাহাড়তলী বাজারে আর কারও নেই। তিনি চট্টগ্রামের চালের বাজারের মাফিয়া ডন।
এছাড়া চালের ব্যবসা ছাড়াও তার রয়েছে জমির প্লট ও ফ্ল্যাট ব্যবসা। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও তিনি চাল সরবরাহের ঠিকাদারি হাতিয়ে নিয়েছেন। যেখানে সরকারি গুদাম ও বেসরকারি মিলের চোরাই চাল সরবরাহ করে থাকেন। এভাবে তিনি চট্টগ্রামে এখন হাজার কোটি টাকার মালিক।
আর তিনি এতই চতুর যে, বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের একনিষ্ট নেতা ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কিন্তু ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর তিনি হয়ে গেছেন বিএনপি-জামায়াতের লোক। যখন যে সরকার আসে তখন সে সরকারের লোক পরিচয়ে নানা অনিয়ম ও অপকর্ম করেন সাহাব উদ্দিন। যার কারণে পুলিশ প্রশাসন তাঁর টিকিটিও ছুঁতে পারেন না।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে চাল ব্যবসায়ী সাহাব উদ্দিন বলেন, এসব কি মোবাইলে বলে শেষ করা যায় আপনি আমার দোকানে আসুন, এক কাপ চা খাব, আর যা বলতে হয় বলব। দোকানে আসা সম্ভব নয় বললে তিনি বলেন, আপনাকে এসব তথ্য কে দিয়েছে, তাকে আমার সামনে আনুন, তারে একটু চিনে রাখতে চাই।
প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, সরকারি চাল-গম বৈধভাবে নিয়ে আমি বাজারে বিক্রি করি। এ কারণে অনেকে মনে করে আমি চোরাই চাল বিক্রি করি। এক সময় কতিপয় তেনাপাডা সাংবাদিকের কথায় এনএসআইসহ যৌথবাহিনী আমার গুদামে অভিযান চালিয়ে হয়রানি করেছে। পরে তারাই বলেছে এ রকম কোন সাংবাদিক আসলে গুদামে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে যেন তাদের খবর দিই।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার সাথে দৈনিক কর্ণফুলী, যুগান্তরসহ অনেক সাংবাদিকের সম্পর্ক আছে।
পাহাড়তলী বাজারে আমার দুই-তিনটি দোকান আছে। আমি দামপাড়া পুলিশ লাইনে চাল, ডাল, সয়াবিন তেল সাপ্লাই দিই। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও চাল সাপ্লাই দেই। এসব ব্যবসা করতে গিয়ে আমার অনেক শত্রু তৈরী হয়েছে। তারা আমাকে হয়রানি করতে আপনার কাছে এসব মিথ্যা তথ্য দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল আজাদ বলেন, আমি এ বিষয়ে অবগত নই। তার বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে। তাকে নজরদারিতে রাখা হবে। চোরাই কাজে জড়িত থাকলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাহাড়তলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজা খান বলেন, সে সরকারি চাল বিক্রি করে সেটা ঠিক, তবে এ বিষয়ে বলা তো মুশকিল। সবকিছু তো আর বলা যায় না। সে দামপাড়া পুলিশ লাইনেও চালসহ আরও অনেক রকম পণ্য সাপ্লাই দেয়। এ কারণে পুলিশ প্রশাসনের সাথে তার ভাল সম্পর্ক আছে। এই ভয়ে কেউ কিছুই বলে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমপির জনসংযোগ কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত উপ কমিশনার মাহমুদা বেগম বলেন, তার কোন বিষয়ে আমি অবগত নই। সে যদি পুলিশ লাইনে চাল সরবরাহ করে তা জানা যাবে সাপ্লাই শাখায়। তবে তার বিষয়টি নজরে আনা হবে।
(বি: দ্র:- চালের বাজার ঘিরে সাহাব উদ্দিনের নানা অপতৎপরতা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে দৈনিক ঈশানে। দ্বিতীয় পর্ব আসছে ‘সরকারি গুদাম ও মহাসড়কে চাল চুরি নিয়ে সাহাব উদ্দিনের চোর চক্র সক্রিয়’ শিরোনামে। প্রিয় পাঠক চোখ রাখুন আপনাদের প্রিয় দৈনিক ঈশানে)