
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের পারিবারিক গাড়িচালক ইলিয়াসের ঘরে অভিযান চালিয়ে মিলেছে দেশে-বিদেশে গড়ে তোলা অবৈধ সম্পদের ৫৮২ নথি। ২৩ বস্তায় থাকা এসব নথি উদ্ধার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) ভোরে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা এলাকার সিকদার বাড়ি এলাকায় এই অভিযান চালানো হয় বলে জানান দুদক, চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর উপপরিচালক সুবেল আহমেদ।
তিনি জানান, বিদেশে থাকা ৫৮২টি ফ্ল্যাট ও বাড়ি হস্তান্তর ঠেকাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত রোববার দুপুরে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারিরও আদেশ দিয়েছেন।
সুবেল আহমেদ জানান, সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া জাবেদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আরামিট গ্রুপের দুই সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) আব্দুল আজিজ ও উৎপল পালের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এসব আলামত জব্দ করা হয়েছে। বিষয়টি উপস্থাপনের পর আদালত ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির আদেশ দেন।
অভিযানে নেতৃত্ব দেন জাবেদের বিরুদ্ধে ২৫ কোটি টাকা পাচার সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মশিউর রহমান। তিনি জানান, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের স্ত্রী রুখমিলা জামানের গাড়িচালক ইলিয়াসের শিকলবাহার বাড়িতে অর্থপাচার ও দেশি-বিদের্শি অবৈধ সম্পদের বিভিন্ন নথি লুকানো আছে। এই তথ্য পেয়ে অভিযান চালানো হয়।
অভিযানের আশঙ্কায় ইলিয়াস তার বাড়ি থেকে সব নথি ওসমান তালুকদার নামে তার এক চাচাতো ভাইয়ের বাসায় সরিয়ে রাখেন। পরে তালা ভেঙে ওই বাসা থেকে ২৩ বস্তা নথি জব্দ করা হয়। এসব নথি বিদেশে টাকা পাচার ও বিভিন্ন ব্যবসা সংক্রান্ত। নথিগুলো পর্যালোচনা করে বিস্তারিত জানা যাবে বলে জানান মশিউর রহমান।
দুদকের তথ্যমতে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে দায়ের হওয়া মামলায় দু‘জনকে নগরীর ডবলমুরিং থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে দুদকের টিম। এরপর তাদের আদালতের নির্দেশে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরমধ্যে আরামিট গ্রুপের এজিএম (ফিন্যান্স) উৎপল পাল সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে বিদেশের স¤পদ অর্জন ও দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন।
সেই সূত্রে উৎপল দেশ থেকে দুবাই এবং দুবাই থেকে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে জাবেদের পরিবারের অর্থ পাচার প্রক্রিয়ার মাস্টারমাইন্ড। তার কাছ থেকে জব্দ করা দুটি ল্যাপটপ ও দুটি মোবাইলে এ সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। অন্যদিকে আব্দুল আজিজ আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়ামের এজিএম হিসেবে জাবেদের স¤পদ কেনা-বেচা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। গ্রেফতার আব্দুল আজিজ মামলাটির এজাহারভুক্ত আসামি। আর দুদকের তদন্তে অপরাধের সঙ্গে স¤পৃক্ততা উঠে আসায় উৎপলকে গ্রেফতার করা হয়।
গত ২৪ জুলাই দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. মশিউর রহমান চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ে-১ এ মামলাটি করেন। মামলায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার স্ত্রী, ভাই-বোন এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ৩১ জনকে আসামি করা হয়।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা আরামিটের কর্মকর্তাদের নামে পাঁচটি নামসর্বস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলেন। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে গম, ছোলা, হলুদ ও মটর আমদানির জন্য ১৮০ দিনের মধ্যে ফেরতযোগ্য টাইম লোন আবেদন করেন। নিজ পরিবারের মালিকানায় থাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে (ইউসিবিএল) এ আবেদন করা হয়।
ইউসিবিএল থেকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর হওয়ার পর সেই টাকা একই ব্যাংকে বাকি চারটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা অ্যাকাউন্ট নম্বরে বিভিন্ন অংকে স্থানান্তর করা হয়। পরে সেই টাকা পাচার করা হয়। গ্রেফতার আব্দুল আজিজের নামে ই¤েপরিয়াল ট্রেডিং নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছিল। ইউসিবিএল ব্যাংক থেকে আত্নসাত করা টাকার কিছু অংশ সেই প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
দুদক বলছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ মন্ত্রী থাকার সময় ২০১৯-২০ সালে জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ আত্নসাতের এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের নামে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৯টিসহ অন্যান্য দেশে বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/জমি ও স্থাবর স¤পদ ক্রোক ও ফ্রিজ করার আদেশ দিয়েছেন বাংলাদেশের আদালত।
এছাড়া গত ৫ মার্চ অপর এক আদেশে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নামে থাকা ৩৯টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের (অবরুদ্ধ) আদেশ দেন আদালত। এসব ব্যাংক হিসাবে তাদের ৫ কোটি ২৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা জমা রয়েছে। অপর এক আদেশে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাইফুজ্জামানের ১০২ কোটি টাকার শেয়ার ও ৯৫৭ বিঘা জমি জব্দেরও আদেশ দেন আদালত।
আর ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। ওই মামলার সূত্রে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার স্ত্রী রুখমিলা জামানকে গ্রেফতারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির জন্য আদালতে আবেদন করেছে দুদক।
সূত্র আরও জানায়, আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে তার বিরুদ্ধে বিদেশে বিপুল স¤পদ গড়ার অভিযোগ ওঠে।
এরপর তাকে আর পরবর্তী সরকারে মন্ত্রী হিসেবে দেখা যায়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগমুহুর্তে জাবেদ তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।
ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির আদেশ
সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের সিনিয়র ¯েপশাল জজ মো. আবদুর রহমান এ আদেশ দিয়েছেন। বিদেশে থাকা ৫৮২টি ফ্ল্যাট ও বাড়ি হস্তান্তর ঠেকাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত এ আদেশ দিয়েছেন।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোকাররম হোসাইন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) থেকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পাচারের অভিযোগে করা একটি মামলায় দুদক গত ১৮ সেপ্টেম্বর আদালতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির আবেদনটি করেছিল।
দুদকের পিপি মোকাররম হোসাইনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ২৫ কোটি টাকা পাচারের মামলা তদন্তে নেমে দুদক বিদেশে তাদের মালিকানাধীন ৫৮২টি ফ্ল্যাট ও বাড়ির তথ্য পায়। দেশ থেকে পাচার করা টাকায় তারা বিদেশে এসব স¤পদ গড়েছেন। পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার মধ্যে জাবেদ ও তার স্ত্রী এসব ফ্ল্যাট-বাড়ি বিক্রি বা হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন বলে দুদক তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে। হস্তান্তর ঠেকাতে জাবেদ ও তার স্ত্রীর নামে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়।
উল্লেখ্য, আদালতের নির্দেশে, প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) অথবা তদন্ত সংস্থার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল বুরো (এনসিবি) শাখা ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদন করে থাকে।