
আওয়ামী লীগ সরকারের আলোচিত-সমালোচিত সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সাবেক প্যানেল মেয়র এবং রামপুর ২৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটনের নকল সিগারেটের কারবার এখন কুষ্টিয়া অঞ্চলে।
জেনুইন লিফ টোব্যাকোর নামে কারখানা নির্মাণ করে নামিদামি ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট তৈরি করছে এই সিন্ডিকেট। যা ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে দীর্ঘদিন ধরে তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর নামে বীরদর্পে চালিয়েছিল চট্টগ্রামে। আর ফাঁকি দিয়েছিল সরকারের হাজার কোটি টাকা রাজস্ব।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও তার ব্যবসায়িক পার্টনার আব্দুস সবুর লিটন পালিয়ে যান। এরপর এনবিআরের অভিযানের মুখে চট্টগ্রাম ছেড়ে তারা কুষ্টিয়ায় গেড়েছেন তামাক ব্যবসা ও নকল সিগারেট তৈরির কারবার। এক্ষেত্রে তারা এনেছেন আমুল পরিবর্তন।
চট্টগ্রামে যেখানে লিটন তার ভাই ও আওয়ামী লীগের শক্তিশালী সিন্ডিকেট দিয়ে নকল সিগারেটের অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করতেন, সেখানে কুষ্টিয়ায় নিয়োজিত করেছেন স্থানীয় বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের। যাদের ছত্রছায়ায় কুষ্টিয়ার তিন উপজেলায় একাধিক অফিস ও কারখানা চালু করেছে। এমনকি তারা ইন্টারন্যাশনাাল টোব্যাকোর নাম পরিবর্তন করে রেখেছেন জেনুইন লিফ টোব্যাকো নামে। ঝুলানো হয়েছে নতুন নামের সাইন বোর্ডও।
কুষ্টিয়ায় অবস্থিত জেনুইন লিফ টোব্যাকো কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারির সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে তথ্য প্রদানের সময় তাদের কেউ-ই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তারা জানান, বর্তমানে কুষ্টিয়া অঞ্চলে জেনুইন লিফ টোব্যাকো কোম্পানির সব কিছু দেখভাল করছেন সিইও জাহিদ, জিএম বেলাল হোসেন ও নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।
কুষ্টিয়ার ত্রিমোহনী এলাকায় মনছুর ভবনে জেনুইন লিফ টোব্যাকোর অফিসে গিয়ে দেখা যায়, অফিসে কোনো কর্মকর্তা নেই। নিরাপত্তাকর্মীসহ কয়েকজন কর্মচারি রয়েছেন। তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান। এ সময় তাদের চোখে-মুখে ছিল ভয় ও আতঙ্কের ছাপ।
মিলন নামে স্থানীয় এক যুবকের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভবন ভাড়া নিয়ে তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো কয়েক বছর ধরে অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর সাইন বোর্ড নামিয়ে জেনুইন লিফ টোব্যাকোর সাইন বোর্ড টাঙানো হয়। তবে নাম পরিবর্তন হলেও অফিসের আসবারপত্র ও কর্মরতদের অনেকেই এখনো আছেন। কোম্পানির পুরনো কর্মকর্তা বেলাল হোসেন সব কিছু দেখভাল করেন।
একাধিক সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, মিরপুর ও ভেড়ামারা উপজেলায় একাধিক গোপন কারখানায় নামিদামি ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট তৈরি করছে জেনুইন লিফ টোব্যাকো। দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুন্ডি ইউনিয়নের প্রতাপপুর এলাকায় এবং আড়িয়া ইউনিয়নের বড়গাংদিয়ার জহুরাগঞ্জ মাঠে মধ্যে নকল সিগারেট তৈরির কারখানা স্থাপন করেছে নওফেল ও লিটন।
উপজেলা বিএনপির দুই প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় কারখানার মধ্যে অনেকটা প্রকাশ্যে তৈরি করা হচ্ছে নকল সিগারেট। বিএনপি নেতাদের হুমকিতে এসব বিষয়ে স্থানীয় কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার ১২ মাইল নামক স্থানেও রয়েছে জেনুইন লিফ টোব্যাকো কোম্পানির কারখানা। শহরের ছয় রাস্তার মোড়সহ একাধিক স্থানে আলিশান অফিস রয়েছে নকল সিগারেট সিন্ডিকেটের। যেখান থেকে নির্বিঘ্নে গোল্ডলিফ, বেনসনসহ বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট তৈরি করে বাজারজাত করছে চক্রটি।
এছাড়া শহরের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে বিলাসবহুল সাফিনা টাওয়ারে গ্যারেজসহ ৭টি ইউনিট ভাড়া নেয় জেনুইন লিফ টোব্যাকো কোম্পানি। এই গ্যারেজ থেকে গত ১০ জুন রাতে ভারতে নিহত সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের কোটি টাকা দামের ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ব্র্যান্ডের গাড়ি উদ্ধার করে পুলিশ। শক্তিশালী এ সিন্ডিকেটের হেফাজতে রয়েছে সাবেক এমপি ও মন্ত্রীদের একাধিক নামিদামি গাড়ি। বিদেশি বায়ারদের রাখার নামে এসব অফিসে চলে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড।
এ অফিসে রাজনৈতিক দলের নেতাসহ জেলার প্রভাবশালীদের গোপনে যাতায়াত রয়েছে। এসব অফিস থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থাকে। ওই গ্যারেজটি ভাড়া নিয়েছিল আব্দুস সবুর লিটনের মালিকানাধীন তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো। টাওয়ারের মালিকের সাথে ভাড়ার চুক্তিপত্রে জেনুইন লিফ টোব্যাকো কোম্পানির পক্ষে স্বাক্ষর করেন মেহেরপুর জেলার গাংনী পৌরসভার বাঁশবাড়িয়া দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান খোকন। আনারের গাড়িটি মোস্তাফিজুর রহমানের ভাড়া করা পার্কিং স্পেসেই ছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোস্তাফিজুর রহমান গাংনী পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি। গাড়িটি নওফেলের মাধ্যমে আব্দুস সবুর লিটনের মালিকানাধীন জেনুইন লিফ টোব্যাকো কোম্পানির লোকজন এখানে নিয়ে এসেছে। ঘটনার পর থেকে কোম্পানির সিইও জাহিদ, জিএম বেলাল হোসেন ও নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান গা ঢাকা দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। কর্মকর্তা সকলের মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। তাদের অফিসে গিয়ে কেয়ারটেকার ও দারোয়ানকে ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি।
তবে জেনুইন লিফ টোব্যাকো কোম্পানির পাবলিক রিলেশন অফিসার এ এম সালেহীন তৌহিদ বলেন, কোম্পানির বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আমি নতুন যোগদান করেছি, কিছুই জানি না। স্যাররা কোথায় আছে তাও আমি বলতে পারবো না।
পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সামনের ভবনের নিরাপত্তাকর্মী আশিকুর রহমান বলেন, গত বছরের ১ জুলাই মোস্তাফিজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি ভবনের তিনটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। পরে আরও চারটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। তিনি তামাক কোম্পানিতে বড় পদে রয়েছেন।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান হাবলু মোল্লা বলেন, তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর সাথে আমার কোন ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। তবে আমার জমিতে তারা ইন্টারন্যাশনাল ওয়্যার হাউজ নির্মাণ করে তামাক ক্রয় করে। আমি নিজেও তাদের কাছে তামাক বিক্রয় করি। পরে মজুতকৃত তামাক তারা বিদেশে রপ্তানি করে। তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর নাম পরিবর্তন করে কিছুদিন আগে জেনুইন লিফ টোব্যাকো কোম্পানি নামকরণ করা হয়েছে বলে স্বীকার করেন এই বিএনপি নেতা।
কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) ফয়সাল মাহমুদ বলেন, এ ধরনের কোনো সিন্ডিকেটের সুনির্দিষ্ট তথ্য পুলিশের কাছে নেই। তবে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। গাড়িটি কারা কীভাবে টোব্যাকোর গ্যারেজে এনেছে, সব কিছু মাথায় নিয়েই পুলিশ কাজ করছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি নামিদামি কোম্পানির নকল সিগারেট তৈরি ও নকল ব্যান্ডরোল লাগিয়ে বাজারে সরবরাহ করে আসছে আবদুস সবুর লিটন। তার অবৈধ এই ব্যবসার সারথি মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। অভিযোগ রয়েছে, বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো ও তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর মাধ্যমে নওফেল ও লিটন রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে লোপাট করেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। ৫ আগস্টের পর ঢাকায় তাদের একাধিক কারখানায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির প্রামাণ পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
টোব্যাকো সংক্রান্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উচ্চ পর্যায়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ভয়াবহ এসব চিত্র উঠে এসেছে। লিটনের ব্যাংক হিসাবে সিগারেট বিক্রির প্রায় ৮০২ কোটি টাকা জমা হওয়ার তথ্যও পেয়েছে এনবিআর। লিটনের তারা টোব্যাকোর তৈরি বিদেশি অরিস ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট উৎপাদন করে বাজারজাত করারও প্রমাণ পেয়েছে এনবিআর। ফলে লিটন ও তার পরিবারের আয়কর নথি অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
এনবিআর সূত্র জানায়, তারা গ্রুপ ঢাকার র্যাপিড মার্কেটিং, মুন এন্টারপ্রাইজ ও বেঙ্গল লিফ নামের এই তিন কোম্পানির মাধ্যমে সিগারেটের উপকরণ আমদানি করতেন। আর এই উপকরণ র্যাপিড প্যাকেজিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রহণ করেছে তারা টোব্যাকো। এছাড়াও অস্তিত্বহীন কিছু প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকার সিগারেটের উপকরণ আমদানি করে তারা টোব্যাকো সরবরাহ করেছে। এই জালিয়াতিতে রয়েছে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের প্রতিষ্ঠান বিজয় টোব্যাকো।
প্রতিষ্ঠানগুলো চট্টগ্রামভিত্তিক দুটি কারখানায় বিদেশি অরিস ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট তৈরি করে বাজারজাত করেছে। এই সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ছিল প্রায় ডজনখানেক নামসর্বস্ব কোম্পানি। এসব কোম্পানির অনিয়ম বন্ধে এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে।
এই কমিটি ১৯টি প্রতিষ্ঠানের আমদানি ও সরবরাহের তথ্য অনুসন্ধান করে এই প্রতিবেদন দাখিল করেছে। ১১০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে দেশে নকল সিগারেট তৈরির বিভিন্ন বিষয় অনুসন্ধান করেছে। একইসঙ্গে নাম-ঠিকানাবিহীন প্রতিষ্ঠানের আমদানি তথ্যও পেয়েছে। বন্ধ রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে এখনো টাকা জমা হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তারা গ্রুপের সঙ্গে প্রায় পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সরাসরি সম্পৃক্ততা পেয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান সিগারেটের উপকরণ আমদানি করে বিজয় ও তারা টোব্যাকোকে সরবরাহ করেছে। এছাড়া মিথ্যা ঘোষণায় সিনথেটিক আমদানির আড়ালে সিগারেটের উপকরণ আমদানির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
সূত্র আরও জানায়, তারা গ্রুপের মালিক আব্দুস সবুর লিটনের কর্মচারি শহীদুল আলমের নামে আলম ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়েন। মূলত এই প্রতিষ্ঠানের শহীদুল আলম বিভিন্ন সময়ে তারা গ্রুপের অর্থ জমা ও উত্তোলনের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এই শহীদুল আলমই আলম ট্রেডার্সের মাধ্যমে তারা গ্রুপের ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমা করতেন।
নকল এই সিগারেট তৈরি ও বাজারজাতের আরও দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান একে এন্টারপ্রাইজ ও আফসার অ্যান্ড ব্রাদার্স। প্রতিষ্ঠানগুলো তারা ট্রেড লিংক কোম্পানির হিসাবে অর্থ জমা করেছে। এ ছাড়া সিগারেট তৈরির উপকরণও সরবরাহ করেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) ডেপুটি কমিশনার নুরুল বশির বলেন, বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো এবং তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো নকল সিগারেট তৈরি এবং নকল ব্যান্ড রোল লাগিয়ে সরবরাহ করার অভিযোগ ওঠার পর গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আবদুস সবুর লিটনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো। যার ই-টিআইএন নাম্বার-২৭৮২১৮৬৫৯৫৮৫, বিআইএন নাম্বার-০০২৫৬৮৯০২-০৫০৭ এবং ও তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর ই-টিআইএন নাম্বার-২৬৭৬৩৩৭০৪৬২১ ও বিআইএন নাম্বার-০০০১৩৩৩০১-০৩০৬। এরমধ্যে একটি কোম্পানির ৪০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের।
অভিযোগ রয়েছে, বিজয় এবং তারা ইন্টারন্যাশনাল কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সিগারেট তৈরির কাঁচামাল-অ্যাসিটেট টো, পরিশোধিত তামাক ও সিগারেট মোড়ানোর জন্য কাগজ সংগ্রহ করে। পরে কক্সবাজারের চকরিয়া এবং কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শিবপুরের কারখানায় নকল সিগারেট তৈরি করে। তাদের কারখানায় তৈরি হওয়া বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটে লাগানো হয় নকল ব্যান্ডরোল। নকল এ সিগারেট দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো ও তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো প্রতিষ্ঠার পর থেকে কমপক্ষে ১০ হাজার টন সিগারেট তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করেছে সিগারেটের কাঁচামাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে; যা দিয়ে পাঁচ কোটি সিগারেটের শলাকা তৈরি সম্ভব।
এখানে সরকার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ রাজস্ব হারিয়েছে কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া লিটন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তামাক কোম্পানির সিগারেটের শলাকায় ব্যবহার করা ব্যান্ডরোল সংগ্রহ করে পুনরায় ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা পানের দোকান থেকে সিগারেট কোম্পানির ব্যবহার করা ব্যান্ড রোল সংগ্রহ করেন। এজন্য প্রতি কেজিতে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা দেওয়া হয় দোকানদারকে। পুরোনো ব্যান্ডরোল বারবার ব্যবহার করে এ সিন্ডিকেট ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ লোপট করেছে কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বিদেশি ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট ও ব্যান্ডরোল জালিয়াতি করে দুই প্রতিষ্ঠান লোপাট করেছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বিজয় ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হয়। এ কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন চসিকের সাবেক প্যানেল মেয়র ও নওফেল ঘনিষ্ঠ আবদুস সবুর লিটন। কোম্পনিতে শেয়ারের সংখ্যা ১০ হাজার। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন লিটনের ভাই আবদুল মান্নান খোকন। তাঁর শেয়ারের সংখ্যা ২ হাজার।
ওই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার রয়েছে নিহান ইনভেস্ট হোল্ডিং লিমিটেডের প্রতিনিধি এমা ক্লেয়ার বার্টন। এমার স্বামী হিসেবে মহিবুল হাসান চৌধুরীর নাম উল্লেখ রয়েছে। ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে ২০৭ চশমা হিল আবাসিক এলাকা, খুলশী, চট্টগ্রাম; যা মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের পৈতৃক নিবাস। সূত্র বলছে, নিহান ইনভেস্ট হোল্ডিং লিমিটেডের ৯৯ শতাংশ শেয়ার হচ্ছে নওফেল ও তাঁর স্ত্রী এমার। বাকি এক শতাংশ তাদের এক পারিবারিক বন্ধুর।
জানা যায়, বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো এবং তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো নকল সিগারেট তৈরি এবং নকল ব্যান্ডরোল কারখানার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে বারবার অভিযান পরিচালনা করেছে বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু প্রতিবারই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে দুই প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর তারা ইন্টারন্যাশনালের কারখানায় যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে ৫৩ হাজার অবৈধ রাজস্ব স্ট্যাম্প এবং ১৩ লাখ ১৯ হাজার ৮২০ শলাকা সিগারেট জব্দ করা হয়। পরে নকল সিগারেট উৎপাদনের অভিযোগে তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো কোম্পনিকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এর আগে ৯ মে শুল্ক গোয়েন্দা তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোতে অভিযান চালায়। গত ২১ মে শুল্ক গোয়েন্দারা কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় বিজয় ইন্টারন্যাশনালের কার্যালয়ে অভিযান চালান। সেখানে নকল সিগারেট তৈরির মালামাল জব্দ করা হয়। বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো এবং তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর নকল সিগারেট ও নকল ব্যান্ডরোল লাগিয়ে সিগারেট সরবরাহের অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করে সিআইডি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর থেকে পলাতক সাবেক মন্ত্রী নওফেল এবং প্যানেল মেয়র লিটন। তাঁদের মোবাইলও রয়েছে বন্ধ। তাই অভিযোগের বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।