রবিবার- ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫

চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়ায় জ্বরের চেয়ে কষ্ট বেশি খরচে!

চট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়ায় জ্বরের চেয়ে কষ্ট বেশি খরচে!

# কিট নেই সরকারি হাসপাতালে
# বেসরকারি হাসপাতাল যেন লুটের বাজার

ট্টগ্রামে চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণে জ্বরে ভোগার চেয়ে রোগীদের কষ্ট বেশি হচ্ছে খরচে। সরকারি হাসপাতালে কিট নেই এই জ্বর টেস্টের। এ সুযোগে লুটের বাজার বানিয়ে ফেলেছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। যেখানে সর্বনিম্ন ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার টাকার পর্যন্ত খরচ হচ্ছে জনপ্রতি।

সেখানেও টেস্ট নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন ও কারচৃুপির অভিযোগ। এ নিয়ে বেশ হতাশ জ্বরে ভোগা রোগীরা। কেউ কেউ অর্থ সংকটে টেস্ট না করিয়ে চুপ থাকছেন সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করে। এ অবস্থায় চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ বাড়ছে শহরজুড়ে।

চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের তথ্যমতে, এ বছর গত ১ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীতে প্রায় চার হাজার ১০০ জন চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন।

বিআইটিআইডির অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশীদ বলেন, জ্বর নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীদের প্রায় ৫০% চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। জ্বর চলে গেলেও জয়েন্ট ব্যথা ও ফোলা ২-৩ মাস পর্যন্ত থাকতে পারে। অন্য কোনো রোগ থাকলে প্রভাব পড়তে পারে।

চিকিৎসকরা সতর্ক করেছেন, জ্বর বা অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিলে নিজে নিজে চিকিৎসা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। জ্বর আসলেই ল্যাব টেস্ট করা উচিত।

সরকারি হাসপাতালে কিট নেই
চট্টগ্রামে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে চিকুনগুনিয়া। শহরের বহু মানুষ জ্বরে কাতর, গিঁটে ব্যথা, শরীর ফুলে যাওয়া আর অজানা দুর্বলতায় দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু তাদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে তুলছে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকুনগুনিয়া শনাক্তের পরীক্ষার কিট না থাকা। ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত রোগীদের দুশ্চিন্তার যেন শেষ নেই।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, চিকুনগুনিয়ার টেস্ট কিট সরকারি পর্যায়ে নেই, তবে গত ২৮ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো চিঠিতে জরুরি ভিত্তিতে র‌্যাপিড টেস্ট কিট সরবরাহের অনুরোধ করা হলেও তা মিলেনি এখনো। ফলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডি-তে পিসিআর ল্যাব সুবিধা থাকলেও কিট না থাকায় পরীক্ষা হচ্ছে না। উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা করানোই অসম্ভব।

আরও পড়ুন :  কাস্টমসের দুই কর্মকর্তার ওপর হামলা, নেপথ্যে কারা?

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল ফয়সাল মো. নুরুদ্দিন চৌধুরী জানান, এই মৌসুমে প্রচুর ভাইরাস জ্বর হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ রোগীই শেষ পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া পজিটিভ প্রমাণিত হচ্ছেন। পরীক্ষা করাতে না পারায় অনেকেই সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. এইচএম হামিদুল্লাহ মেহেদী জানান, আমাদের কাছে আসা রোগীদের প্রায় ৮০ শতাংশেরই চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ আছে। কিন্তু টেস্ট খরচ বেশি হওয়ায় অনেকে পরীক্ষা করাতে পারছেন না।

বেসরকারি ল্যাবের ফি ভিন্নতা
চট্টগ্রামে বিভিন্ন বেসরকারি ল্যাবে চিকুনগুনিয়া আরটি-পিসিআর টেস্টের ফি সর্বনিম্ন ৪,৫০০ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। উদাহরণস্বরূপ: চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল: ৪,৫০০ টাকা, এপিক হেলথ কেয়ার: ৬ হাজার টাকা, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার: ৫,৫০০ টাকা।

অথচ করোনার আরটি-পিসিআর টেস্টের সরকারি নির্ধারিত ফি ২,০০০ টাকা, যা চিকুনগুনিয়ার তুলনায় পাঁচগুণ কম। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের উদ্যোগে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক বৈঠকে চিকুনগুনিয়ার সর্বোচ্চ টেস্ট ফি ৪ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এতেও অনেক রোগীর কষ্ট লাঘব হচ্ছে না।

চকবাজারের চন্দনপুরা এলাকার বাসিন্দা আবু হোসাইন খান বলেন, এক সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছি। প্রথমে জ্বর, তারপর মাথা ও গিঁটে ব্যথা শুরু হলো। ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। পরে চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে। জ্বর সেরে গেলেও এখনো শরীর দুর্বল আর জয়েন্টে ব্যথা রয়ে গেছে। সংসার চালানোই যেখানে কষ্ট, সেখানে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে পরীক্ষা করানো সত্যিই কঠিন।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, সরকারি ভাবে চিকুনগুনিয়ার কোনো নির্ধারিত ফি নেই। দ্রুত মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারণ আশা করছি।

আরও পড়ুন :  খাতুনগঞ্জে উপচে পড়ছে ভোগ্যপণ্য

চিকুনগুনিয়ার ২০ হটস্পট
চিকুনগুনিয়ার প্রকোপের জন্য চট্টগ্রামে নগরীর ২০টি ¯পটকে হট¯পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সাথে পাঁচটি জায়গাকে অতিঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ধরা হয়েছে। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ৮০ শতাংশ রোগীই এসব এলাকার বাসিন্দা।

এলাকাগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহর, আগ্রাবাদ, বন্দর, সদরঘাট, ডবলমুরিং, খুলশী, বায়েজীদ, চান্দগাও, কোতোয়ালি, ইপিজেড, পাহাড়তলী, চকবাজার, লালখানবাজার, বাকলিয়া, দেওয়ান বাজার, দেওয়ান হাট, ঝাউতলা, আন্দরকিল্লাহ, নাসিরাবাদ, পাঠানটুলী এলাকা।

এর মধ্যে হালিশহর, আগ্রাবাদ, বন্দর, সদরঘাট, ডবলমুরিং এলাকাকে অতিঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সম্প্রতি সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এসব এলাকায় দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দিয়েছে সিভিল সার্জন।

নগরবাসীর ক্ষোভ
চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর পাশাপাশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে চিকুনগুনিয়া। ৩০০ টাকা ডেঙ্গু পরীক্ষা করা গেলেও চিকুনগুনিয়া পরীক্ষায় বেসরকারি হাসপাতালে গুণতে হচ্ছে সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। যে অর্থ ব্যয় করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। অনেকে বাধ্য হয়ে পরীক্ষা না করেই কষ্ট সহ্য করে বাড়িতে বসে আছেন।

বিআইটিআইডির অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশীদ বলেন, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ভাইরাস ফ্লু-সবই এখন প্রকট। কিন্তু ডেঙ্গুর তুলনায় চিকুনগুনিয়ায় বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। মশা নিধন না হলে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

অন্যদিকে মশক নিধনেও নেই তেমন কার্যকর উদ্যোগ। বিভিন্ন এলাকায় জমে থাকা পানিতে মশার উপদ্রব বাড়লেও ওষুধ ছিটানোর কাজ সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। মশার কামড়ে জর্জরিত নগরবাসীর জীবন। অনেক পরিবারেই একাধিক সদস্য চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। জ্বর শেষে যে ব্যথা শরীরে রেখে যায়, তা মানুষের কর্মক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে। দিনমজুর, রিকশাচালক, দোকানদারদের আয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

সদরঘাট এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল বলেন, আমাদের এলাকায় ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়া। উপসর্গ নিয়ে কেউ রক্ত পরীক্ষা করলেই পাওয়া যাচ্ছে এ ভাইরাসের অস্তিত্ব। এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে ল্যাব টেস্ট না করে রিপোর্ট দিয়ে কারচুপিও করছে। চিকুনগুনিয়ার কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে আতঙ্কিত আমরা।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ৯০ লাখ টাকার সিগারেটভর্তি লাগেজ

চিকিৎসকেরা বারবার বলছেন-চিকুনগুনিয়া কোনো হালকা জ্বর নয়। সঠিক সময়ে পরীক্ষা ও চিকিৎসা না হলে এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে শরীরে থেকে যেতে পারে। তাই সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে কিট সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করার দাবি জানানো হয়।

সিটি মেয়রের বক্তব্য
মশক নিধন কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহী জানান, মশার হট¯পট ধরে ক্রাশ কর্মসূচি চলছে। আমাদের ২১০ জন কর্মী ও ৬টি ¯েপশাল টিম কাজ করছে।

সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, মাসব্যাপী মশক নিধন কার্যক্রম চলছে। যে সব এলাকা হট¯পট সেখানে আমরা প্রতিনিয়ত ওষুধ মারছি। নতুন মশার ওষুধ দিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে মশক নিধক কার্যক্রম চলছে।

চিকিৎসকরা যা বলছেন
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গুর তুলনায় চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের হার বেশি। রোগ নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশন, স্বাস্থ্য বিভাগ ও অন্যান্য সংস্থার সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর উদ্যোগ দরকার।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ চলছে। আমরা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত। তবে মানুষকে সচেতন হতে হবে। মশা দমন ও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন এড়িয়ে চলতে হবে।

চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. মোহাম্মদ তৌহিদুল আলম বলেন, চিকুনগুনিয়ার জন্য সরকারি নির্ধারিত ফি নেই। তবে ডেঙ্গুর মতো একই মূল্য নেওয়া যেতে পারে। কেউ অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।

ঈশান/মম/সুপ

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page